চেম্বারের উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠক
সিলেটের সামগ্রিক উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:২৫:৫৫ অপরাহ্ন

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য আলাদা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে ॥ মোঃ এহছানে এলাহী
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটের সামগ্রিক উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বক্তারা। তারা এ অঞ্চলের উন্নয়নে খাতভিত্তিক (সেক্টরাল) মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের ওপরও জোর দেন। এজন্য একটি আঞ্চলিক কমিশন গঠনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
গতকাল শনিবার বৃহত্তর সিলেটের আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সিলেট সার্কিট হাউসে সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোগে এ গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়। সিলেট অঞ্চলের পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক ছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এতে আলোচনায় অংশ নেন।
বৈঠকে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এহছানে এলাহী বলেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের সকলকে পরিবর্তন হতে হবে। আমাদেরকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজের কাজটি ঠিকমত করতে হবে। সবাই নিজ দায়িত্ব ঠিকমত পালন করলে কোথাও কোন সমস্যা থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর কথার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সোনার বাংলাদেশ গঠনের জন্য সোনার মানুষ লাগবে।
প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে রূপকল্প-২০৪১ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে এহছানে এলাহী বলেন, তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হবে। তিনি বলেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী বাংলাদেশীগণকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তাদের কাজের উপযোগী কর্মক্ষেত্র এখানে তৈরী করতে হবে। তিনি জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১২ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়, এ সংখ্যাকে ২২ লক্ষে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের কাজ শুরু হয়েছে, আমরা আশাবাদী ২টি সার্ভিস লেনসহ ৬ লেন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল (নর্থ-ইস্ট) বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটের জন্য আলাদা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। সিলেটে নতুন বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন, ভোলাগঞ্জে ইমিগ্রেশন চালুসহ সিলেটের যেকোন সমস্যাবলী সমাধানে তার পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
সভায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন স্কিল্স এন্ড এমপ্লয়মেন্ট এর সিনিয়র পলিসি অফিসার ও বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ এর সাবেক পরিচালক ড. এম এমদাদুল হক বলেন, ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতার কারণে সিলেট বাংলাদেশের মধ্যে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল। সিলেট অঞ্চলের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং সিলেটকে এগিয়ে নিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিলেটের যেসব কর্মকর্তাগণ রয়েছেন তাদেরকে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, একসময় সচিবালয়ে সিলেটের প্রচুর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে সিলেটীদের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এবং মানসম্মত শিক্ষার অভাবে প্রশাসনে সিলেটের কর্মকর্তাদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, সরকারী বিভিন্ন সেবাকে সহজ করতে সেবা বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বে সরকারী সংস্থাগুলোর স্থানীয় অফিসসমূহ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। কারণ রাজধানী থেকে কোন নির্দিষ্ট এলাকা বা জেলার সমস্যা ও সম্ভাবনা ততটা অনুধাবন করা যায় না। তিনি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বা বৃহত্তর সিলেটের আঞ্চলিক উন্নয়নে নর্থ-ইস্ট কমিশন ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এনসিপিডি) বা রিজিওনাল প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (আরপিডিএ) নামে একটি সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম সিলেটের উন্নয়নে একটি আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ গঠন জরুরী বলে মন্তব্য করেন। সিলেটের উন্নয়ন নিয়ে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সভা করতে পারেন বলে তিনি মত দেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির সদ্য প্রাক্তন মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খায়রুল আমিন কোম্পানীগঞ্জে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাইটেক পার্ক আরো বিস্তৃত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকৃত ব্যবসায়ীরা প্লট পাচ্ছেন কিনা সেদিকে সকলকে খেয়াল রাখতে হবে। সিলেটের উন্নয়নে তিনি সেক্টরাল মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের তাগিদ দেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাছুম আহমদ চৌধুরী সিলেটের উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এখানকার উন্নয়নে যার যার সাধ্য অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
কপিরাইট অধিদপ্তরের সাবেক রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী এ গোলটেবিলকে ‘ভয়েস অব সিলেট’ হিসেবে অভিহিত করেন। জালালাবাদ অফিসার্স ফোরামকে আরো শক্তিশালী করা হবে বলে জানান তিনি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সাইফুল হক চৌধুরী বলেন, দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে সিলেট বিভাগে তিনটি টিটিসি (টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার) স্থাপন হচ্ছে। এখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীরা বিদেশ যাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব) বদরুল হক বলেন, ভুল ধারণার কাছে সিলেট উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম দক্ষ মানব সম্পদ তৈরীতে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করার আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় সিলেটে স্পেশাল ইকোনমিক জোন ও বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক স্থাপিত হয়েছে। সিলেট থেকে সরাসরি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে তাজা শাক-সবজি ও ফলমূল রপ্তানির লক্ষ্যে সিলেটে প্যাকিং হাউজ ও সার্টিফিকেশন ল্যাব নির্মাণ, শিল্পখাতে সিলেটকে এগিয়ে নিতে সিলেটে নতুন বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন, জকিগঞ্জ বর্ডার দিয়ে ভারত থেকে বাঁশ আমদানির অনুমতি প্রদান, পর্যটন খাতের উন্নয়নে সিলেটের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন, ভোলাগঞ্জ স্থল শুল্ক স্টেশনে ইমিগ্রেশন চালু সহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বিডা সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক জুলিয়া যেসমিন মিলি, সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, শাবিপ্রবির প্রফেসর ড. ফজলে এলাহী মোঃ ফয়সল, এমসি কলেজের প্রফেসর শেখ মোঃ নজরুল ইসলাম, গোলাপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুর শাফি চৌধুরী এলিম, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক মোহাম্মদ হাফিজ আহমদ, সিলেট চেম্বারের সিনিয়র সহ সভাপতি ফালাহ উদ্দিন আলী আহমদ, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, সিনিয়র সাংবাদিক আল-আজাদ, সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহিত চৌধুরী, এটিএন বাংলার ব্যুরো প্রধান শাহ মুজিবুর রহমান জকন, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, সিলেট চেম্বারের পরিচালক জিয়াউল হক, আলীমুল এহছান চৌধুরী, ফাহিম আহমদ চৌধুরী, সদস্য তোফাজ্জল হোসেন এফসিএ, মাহদি সালেহীন। এসময় উপস্থিত ছিলেন সিলেট চেম্বারের পরিচালক আবু তাহের মোঃ শোয়েব, মুশফিক জায়গীরদার, মুজিবুর রহমান মিন্টু, দেবাংশু দাস, কাজী মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, চ্যানেল এস এর চেয়ারম্যান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সৈয়দ সায়েম উদ্দিন আহমেদ, সিলেট চেম্বারের সচিব মোঃ গোলাম আক্তার ফারুক, ইমজা’র সভাপতি মঈন উদ্দিন মঞ্জু প্রমুখ।
সভায় বক্তাগণ বৃহত্তর সিলেটের উন্নয়নে সময়োপযোগী গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজনের জন্য দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বৃহত্তর সিলেটের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা অপরিহার্য্য। সেই সাথে সিলেটের লোকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদেশ গমনের প্রবণতায় পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ গত কয়েকবছরে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় সিলেট দিন দিন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। তাদেরকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরে দেশে ফিরে এসে দেশের জন্য কাজ করার প্রতি উৎসাহ দিতে হবে। এছাড়াও বক্তাগণ ঢাকা-সিলেট হাই স্পীড ট্রেন চালু, সিলেটে বিশ্বমানের ইউনিভার্সিটি, নার্সিং ইন্সটিটিউট ও ট্রেনিং সেন্টার চালু, কৃষিখাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, সিলেট-চট্টগ্রাম হাইওয়ে নির্মাণ, নতুন বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, সিলেট থেকে বিদেশে দক্ষ কর্মী প্রেরণ, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ও সিলেট সমিতি সহ সিলেটের সামাজিক সংগঠনগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি, সিলেটে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার ও আইটি ইউনিভার্সিটি স্থাপন, সিলেটে পর্যটকসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিমানের ভাড়া হ্রাসকরণ সহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
প্রসঙ্গত, বৈঠকে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি।