মৌসুমি দারিদ্র্য : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:২৬:৫১ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও বাংলাদেশের উত্তর জনপদে বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর জুড়ে আশ্বিন-কার্তিকে (অক্টোবর-নভেম্বর) দরিদ্র মানুষের অভাবের কথা শোনা যেত। উত্তরাঞ্চলের আকালের খবর তখন গণমাধ্যমে অত্যন্ত ফলাও করে ছাপা হতো। পত্রিকার পাতা ঠাসা থাকত পীড়িত মানুষের নানা দুর্দশার প্রতিবেদন আর ছবিতে। উত্তরাঞ্চলের এই অভাব পরিচিত ছিল ‘মঙ্গা’ নামে এই সময়টাকে ‘মরা কার্তিক’ নামেও ডাকা হতো। সরকারের নানা উদ্যোগ, দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরলস প্রচেষ্টা আর সাধারণ মানুষের অব্যাহত শ্রমে উত্তরাঞ্চলের ‘মঙ্গা’র তেজ এখন অনেকটাই প্রশমিত। অনেকে বলেন, উত্তর জনপদের মঙ্গা এখন ইতিহাস। কেউ কেউ বলেন জাদুঘরে। তবে এখনো উত্তরের জনপদে চোখ মেলে তাকালে আকাল নজরে পড়ে। মনে হয়, মঙ্গা এখন আটকে আছে কার্তিকের খামে। তবে উত্তরের এই মঙ্গাকে এখন আর মঙ্গা বলা যাচ্ছে না। যেমন বলা যাচ্ছে না মামা-চাচা, ফুফা-খালু- এরা সবাই এখন আংকেল। গবেষকরা এখন মঙ্গাকে বলছেন মৌসুমি দারিদ্র্য। কেউ কেউ বলছেন মৌসুমি ক্ষুধা।
গত বছর (২০২২ সালে) উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত একটি উপজেলার কর্মরত একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে মারাত্মক মৌসুমি ক্ষুধার সন্ধান পেয়ে বেশ বিচলিত হয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাসে একটি মেয়ের দিকে চোখ পড়ল। দেখছিলাম, মেয়েটি খুব ক্লান্ত, চোখগুলো ছোট ছোট, দেহ ক্ষীণকায়। শিক্ষক ক্লাসে পড়াচ্ছেন, আমিও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম। কিন্তু মেয়েটির খুব বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করা গেল না। দেখে মনে হলো, মেয়েটি প্রায় ঝিমোচ্ছে। তার শরীরে কোনো শক্তি আছে বলে মনে হচ্ছিল না। কাছে গিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি সকালে কি খেয়ে এসেছ? (যদিও সবার সামনে এমন প্রশ্ন নির্যাতনমূলক)। মেয়েটি বলল, ‘পানি খেয়ে এসেছি’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাত খাওনি কেন?’ মেয়েটি বলল, ‘আমাদের বাড়িতে শুধু বিকেলে ভাত রান্না হয়। সেটি সন্ধ্যায় আমরা খাই।’ ইউএনও আরও লিখেছেন, খুব খারাপ লাগল। ভাবছিলাম, ‘শিশুটি না খেয়ে কিভাবে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস করছে?’ ইউএনও না খেয়ে স্কুলে আসা ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এমন ক্ষুধার্ত আরও যেসব শিশুকে তিনি প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি, যেসব শিশু ক্ষুধার অন্ন খুঁজতে গিয়ে স্কুলের পথটাও ভুলে গেছে, তাদের কী হবে? গত বছরের (২০২২ সালের) মার্চে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সিজনাল পভার্টি, ক্রেডিট অ্যান্ড রেমিট্যান্স (মৌসুমি দারিদ্র্য, ঋণ ও প্রবাসী আয়) শীর্ষক এক আলোচনা সভার ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আহমেদ মুশফিক মোবারক তাঁর গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছিলেন। তিনি তাঁর গবেষণায় তুলে এনেছিলেন, নানা কারণে মৌসুমি দারিদ্র্য বাংলাদেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। গবেষণায় মাঠ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ ঠিকমতো খেতে পায় না। যারা তিন বেলা খেতে পায়, তাদেরও খাবারের পরিমাণ কম। প্রোটিন পায় না, খাদ্যনিরাপত্তা থাকে না। তারা সব সময় খাবারের ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত থাকে। অধ্যাপক মুশফকি উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা- গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনির হাটে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। তবে তার গবেষণায় যে চিত্র উঠে এসেছে, অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রেও তা কমবেশি প্রযোজ্য। অধ্যাপক মুশফিকের মতে, যে ২৫ শতাংশ মানুষ নিয়মিত খেতে পায় না, তারাই মৌসুমি দারিদ্র্য। তবে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর- এই তিন মাস ভূমিহীন মানুষের ৫০ শতাংশ খেতে পায় না (প্রথম আলো : ১০ সেপ্টেম্বর- ২০২২)।
মৌসুমি দারিদ্র্য যে শুধু বাংলাদেশের সমস্যা, তা নয়। বরং দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্বএশিয়ার নানা দেশে, বিশেষ করে নেপাল, ভারত আর ইন্দোনেশিয়ায়ও এমন মৌসুমি দারিদ্র্য আছে। নেপালে ক্ষুধার মৌসুম শুরুর আগে মৌসুমি দরিদ্রদের ১০ হাজার টাকার সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হয়। এই টাকা নিয়ে নেপালের মৌসুমি দরিদ্র জনগোষ্ঠী কাজের জন্য ভারত যান এবং বেশ ভালো অংকের টাকা আয় করে তারা দেশে ফেরেন। ভারতে গিয়ে কাজ করতে নেপালের মানুষের ওয়ার্ক পারমিট (কাজের অনুমতি) লাগে না। তাই সরকারের ব্যবস্থাপনায় দেয়া এই ঋণকে পুঁজি করে কাজ খুঁজে নিতে তাদের বেগ পেতে হয় না। বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলের ক্ষুধাপীড়িত অঞ্চল থেকে অনেকেই আকালের মৌসুমে কাজের সন্ধানে বিভিন্ন নগরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানে সুদমুক্ত ঋণের কোনো সুবিধা নেই। তাই দাদনের চড়া সুদে টাকা ধার করে তাদের খরচ জোগাড় করতে হয়। ফলে তাদের কাজের পরিবেশ আর মজুরি নিয়ে দর-কষাকষির দম থাকে না। অন্যায্য মজুরিতেই তাদের রাজি হতে হয়। আয়ের সিংহভাগই চলে যায় দাদনের সুদসহ মূল অর্থ ফেরত দিতে। ইন্দোনেশিয়ার এমন ক্ষুধাপীড়িত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যের মৌসুমে কাজের সন্ধানে দেশের অন্য এলাকায় যাতায়াতের জন্য সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হয়। তাদের এই অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ঋণ ভালোই কাজ করছে। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।
মানুষের ক্ষুধা আছে, দারিদ্র্য আছে। অর্থনৈতিক সংকট তো দিন দিন বাড়ছেই। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হবে কবে তা অনিশ্চিত। মৌসুমি ক্ষুধার জেলা-উপজেলাগুলোতে অন্তত দু’বেলার খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে দিনে একবার বিদ্যালয়ে পেট ভরে খাবার খেতে পারে, হাসতে পারে- এমন উন্নত ব্যবস্থা করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসা সরকারের মহান দায়িত্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।