কবিতার যাপিত জীবন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৩২:০৯ অপরাহ্ন
মুহিবুর রহমান কিরণ
সাহিত্যে কবিতা সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং অগ্রসরমান। সময়, উপলব্ধি, জ্ঞান, বিশ্লেষণ, ভাষা, বাকপ্রণালি এবং জীবন ও জগতের নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কবিতা অগ্রসর হয়েছে, তার নতুন নতুন আবর্তনে। তাই একটি মহৎ কবিতা সমস্ত মানব সম্প্রদায়ের পাঠ্য। এখানে একাত্মবোধ সামগ্রিকতাকে একক অনুভবে জাগ্রত করে। কবিতা হোক সে ফার্সি, জার্মান, ইংরেজি, কিংবা বাংলা। বোধের জায়গায় স্মরণ ও মননের স্তরে সর্বত্র তা বহুমাত্রিকতায় অসামান্য আবেদন সৃষ্টি করে। কবি তিনি হতে পারেন, মির্জা গালিব, খৈয়াম, হাফিজ অথবা ইকবাল। হতে পারেন, হোমার, মালার্মে, এলিয়ট, কীটস অথবা এজরা পাউন্ড। হতে পারেন, বড়ু চন্ডিদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, রবীন্দ্রনাথ অথবা জীবনানন্দ দাশ। সকলেই আপন আপন চিন্তা ও হৃদয়ে নব নব দিগবলয় সৃষ্টি করে নির্মাণ করেছেন কবিতার শরীর ও সৌন্দর্য। তাই প্রাচীন বাংলা কবিতা তার আপন অনুভব ও চিত্রকল্পের অনুপম সৌন্দর্যে আজও স্মরণযোগ্য এবং চিত্তাকর্ষক। (১). অঞ্চলে বদনও ছপাবহ গৌরী/রাজা সুঁনেছিনু চাঁদৌ কো চুরি। (বিদ্যাপতি)। (২). নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন গন্ধ নিন্দিত অঙ্গ/জলদ সুন্দরও কন্ধু কন্নুর নিন্দি সিন্দুর ভঙ্গ। (গোবিন্দ দাস)। (৩). পদ্ম লাজে লাজে জলান্তরে পৈঁসে/তাম্বূল রাতুল হইলো অধর পরশে। (আলাওল)।
উপমা, চিত্রকল্পে বিশেষতঃ রূপ বর্ণনায় এর চেয়ে ঋদ্ধ কবিতা প্রায় বিরল। কিন্তু সময় এবং নিত্য পরিবর্তনশীল মানব মন, তার জিজ্ঞাসার উৎস সন্ধানে বিবর্তিত হয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে অগ্রসর হয়। অতীতকে সে মনে রাখে কিন্তু সময়ের আবর্তনে বর্তমান প্রেক্ষিতই হয় তার নিত্য-গৃহ। সমাজে বা রাষ্ট্রে অথবা পৃথিবীতে যখন বড় কোন ঘটনা, বিপ্লব কিংবা যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কোন পরিবর্তন ঘটে; মানুষের জীবন ভাবনায় ও বিশ্বাসে তখন তার দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যা ফরাসি বিপ্লবে, শিল্প বিপ্লবে ঘটেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে সমগ্র পৃথিবীতে। দুই দুইটা বিশ্ব যুদ্ধে যা যা ঘটেছে তার বিষময় প্রভাবও পড়েছে সারা বিশ্বে। অর্থনীতি, রাজনীতিতে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে মানুষের ভাবনায়। তখন বাস্তবতার অগ্রসরমান চিন্তায় বদলে গেছে মানুষের জীবন-বীক্ষণ। বদলে গেছে সাহিত্য। সাহিত্য বা কবিতায় যাকে আমরা বলি পালাবদল। এমনি করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বের সর্বত্রই পরিবর্তিত হয়েছে শিল্প সাহিত্যের প্রকৃতি। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ঘটেছে পরিবর্তন বা পালাবদল। বাংলা কবিতায় এই পালাবদলের কর্ণধার হিসেবে আবির্ভূত হলেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ প্রমূখ কবিগণ। এদের মধ্যে এই পরিবর্তনের অন্যতম রূপকার হলেন জীবনানন্দ দাশ। সমকাল ও মানুষের আবহমান জীবনধারাকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় নিয়ে এলেন এক বিস্ময়কর শৈল্পিক উচ্চারণ। তার কবিতা আঙ্গিকে, শব্দে, উপমায়, চিত্রকল্পে বাঙময় হয়ে আধুনিক বাংলা কবিতাকে এক নবরূপ দান করলো। যদিও সমকালে তার কবিতা তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করেনি বরং নির্মম সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পাঠক যে, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তীদের চেয়ে জীবনানন্দ দাশের কাব্যের আস্বাদ অধিক নিকটবর্তী ভাবে পায় তার কারন, চেনা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার দৃশ্যমান অনুভব তার কবিতায় অতি জীবন-ঘনিষ্ঠ। এ কালের পাঠকের চৈতন্যের জমি থেকে তার কবিতা উৎসারিত। নিজের আবেগ ও স্বপ্ন কল্পনার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ বাংলার শাশ্বত জীবনের সাথে তার হৃদয়ের সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। তার প্রভাব পরবর্তী প্রায় সকল কবিকেই কমবেশি স্পর্শ করেছে। এ জন্যেই আলোচনায় জীবনানন্দ দাশ এতো প্রাসঙ্গিক। তবে এ কথা অধিক সত্য, একক প্রাসঙ্গিকতায় আধুনিক বাংলা কবিতাকে সম্যক ভাবে অনুধাবন করা যাবেনা। এ জন্যে সবার আনুপর্বিকতা বিবেচ্য। এজন্য চর্চা, মনোযোগ, কবি-প্রতিভা, জীবনবোধ এবং অনুশীলন সব কবিদের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। কারণ, কবিতা নানা রকম। কবিতা আজ বহুমাত্রিক। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কবিতা কী। এর সংজ্ঞা কী। আমার হৃদয় কেমন, একথা যেমন সংজ্ঞা দিয়ে কাউকে বুঝানো যাবেনা ঠিক তেমনি কবিতাও প্রকৃত সংজ্ঞায়িত হয়না। তবু বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক এমনকি অনেক দার্শনিকরাও কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন।
কবিতা কোন নির্দিষ্ট বিধানে সংজ্ঞয়িত হয়না। তবুও বিখ্যাতজনদের অনুধাবন মহৎ কবিতাকে আপন উপলব্ধিতে, আপন অনুভবে নিয়ে আসতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আলোচ্য প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশকে সামনে রাখার একমাত্র কারণ, ক্রম- রূপায়নে আধুনিক বাংলাকবিতার প্রবহমান যাত্রাপথকে স্মরণ করা। যা সাম্প্রতিক কবিদেরকে কবিতা নির্মাণে আরো বেশি প্রাণিত করবে। মনে রাখা প্রয়োজন কবিতা কোন নীতি বাক্য নয়, কবিতা কোন মতবাদ নয়, সমাজ সংস্কারকও নয় এবং এগুলো প্রচারের কোন মাধ্যমও কবিতা নয়। নীতি বাক্য প্রচারের জন্য লোক- শিক্ষকেরা আছেন, মতবাদ প্রচারের জন্য দার্শনিকরা আছেন, সমাজ সংস্কারের জন্য রাজনীতিবিদেরা আছেন। কবির কর্ম তা নয়। অবশ্য এ সবকিছুকে গভীর ভাবে স্পর্শ করার রয়েছে তার অবাধ অধিকার। কবিতা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার গতিপথ এককভাবে নির্দিষ্ট বা নির্ধারণ করা যাবেনা। উদ্দেশ্যে ঠিক করা তার কাজ নয়। কবিতা নানা রকম। সঙ্গতির সৌন্দর্য এবং নিজস্ব উপলব্ধির প্রকাশই কবিতা। তাই কবিতাকে হতে হয় বহুমাত্রিক। কবিতার ডান নেই, বাম নেই। তার একটা নিজস্ব ব্যাকরণ আছে। এখানে বিশ্বের, সমাজের প্রথাগত বোধ , ধারণা, জীবন – দর্শন, সৌন্দর্য- বোধ এবং কল্পনা তার আপন শৈল্পিক উচ্চারণে, অনুভবে সর্বদাই বিশ্বস্ত। সাধারণ ভাবনায় যা অনধীত কবি তার ভাবনায় আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যান। যা আমাদের কাছে অভিনব, বিস্ময়কর। এখানেই তিনি মহৎ কবি। এখানেই তার মহৎ সৃষ্টি।
যে জীবনভাবনা কবির মধ্যে আছে, তার সর্বোত্তম প্রকাশের নামই কবিতা। কবিতায় অনেক কিছুই থাকবে ; তার মধ্যে ছবি থাকবে, সুর থাকবে, ছন্দ থাকবে, নির্বাচিত শব্দ থাকবে, ধ্বনি থাকবে, মুগ্ধতা থাকবে, ঐকান্তিক বোধ থাকবে, জীবনের অনুসন্ধিৎসা থাকবে আর থাকবে সময়ের নির্মোহ উচ্চারণ। দেখতে শুনতে কবিতার মতো কিন্তু তা যদি বহুমাত্রিক না হয়, তবে সেটা আর কবিতা হয়না। যা হয় তার নাম পদ্য। যা হয় তা সামান্য- জ্ঞাপন। কাদা মাটি দিয়ে শিব গড়তে গিয়ে অজ্ঞতা জনিত কারনে কেউ যদি বানরও তৈরী করে ফেলে তার সৃষ্টির প্রতি সম্মান রেখেই বলা যায়, প্রচেষ্টা সুন্দর, উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু বানরকে শিব বলে কেউ যদি বিশ্বাস করতে চান অথবা করাতে চান, অবশ্যই তার কর্ম মহৎ বলা যায়না। প্রচেষ্টা মহত্তর। সৎ প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। এ ওতো সত্য, আমের গাছে মুকুল আসে লক্ষ লক্ষ কিন্তু আম হয় কয়টা। অবশ্য স্বীকার্য, কিছু সংখ্যক কবি বর্তমান সময়েও তাদের কবিতায় বিমুগ্ধ কাব্য- শরীর নির্মাণ করে যাচ্ছেন; কালের কাছে তারাই কাঙ্খিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক