নিপীড়ন নয়, মনুষ্যত্ব চাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৪৭:০১ অপরাহ্ন
দুলাল শর্মা চৌধুরী
ইদানিং পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল, ইন্টারনেট, ফেসবুকে চোখ বুলালে যে খবরটি চোখে পড়ে বেশি তা হলো শিশু ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন। সেইসব ভয়াবহ পৈশাচিক যৌন নির্যাতনের ছবি দেখে ও খবর শুনে মানুষ লজ্জায়, ঘৃণায়, ক্ষোভে, ভয়ে শিউরে উঠছে বার বার। আজ সমাজে শিশু ও নারী নির্যাতনে মানুষ আতঙ্কিত।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশুদের ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হতে হচ্ছে এসব নিষ্পাপ, অসহায়, অবুঝ শিশুদের। শুধু যে শিশুরাই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তা কিন্তু নয়, নানা বয়সের- তিন বছরের শিশু থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত রেহাই মিলছে না মানুষনামী নরপশুদের হাত থেকে। আজ অনেকেই ধর্ষণের শিকার হয়ে মানসিকভাবে, সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনেকেই আত্মহননের পথও বেছে নিয়েছেন যা, সমাজের জন্য এক অশনিসংকেত। আজ আমাদের গোটা সমাজ যেন ধর্ষকের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। তাই তো দেখা যায় একটা ধর্ষণের ঘটনা শেষ হতে না হতেই আরেকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিছু কিছু ধর্ষক যে ধরা পড়ছে না তা নয়। পুলিশ তৎপর হয়ে ঠিকই ধরছে, তবে আইনি ফাঁক ফোকর ও বিচারহীনতার সুযোগ নিয়ে আবার বেরিয়ে আসছে। তারপর আবার ধর্ষণের মত নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছি যে, আজকে যদি দেশের কোন অঞ্চলে ধর্ষণ ঘটানোর পর ধর্ষক ধরা পড়েছে। পরের দিন দেখা যায় দেশের অন্য কোনো অঞ্চলে একই সঙ্গে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেছে এবং আমরা তা পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের মাধ্যমে জানতে পারছি। এতে বোঝা যায় এক শ্রেণির বিকৃত রুচির মানুষ দ্বিগুণ উৎসাহে এইসব জঘণ্য অপরাধমূলক কাজ করে চলেছে ডরভয়হীনভাবে। আর এজন্য দায়ী আমাদের বিচারহীনতা সংস্কৃতি।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৮৩০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১০০ এর বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে নারীদের ওপর পারিবারিক নির্যাতন হয়েছে ৪২২টি, পারিবারিক নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে ১৫৩টি, পারিবারিক নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যা হয়েছে ৭৯টি। গত মাসের অক্টোবরে ঢাকায় ‘নিঃশঙ্ক জীবন চাই, শিশু ও নারী নির্যাতন মুক্ত সমাজের অঙ্গীকার চাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব তথ্য জানান নারী নেত্রীরা। সংবাদ সম্মেলনে নারী নেত্রীরা জানান, দেশের প্রথম সারির ৯টি সংবাদপত্র বিশ্লেষণ করে শিশু ও নারী নির্যাতনের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তারা বলেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অর্জনে নারীদের একটা বড় অবদান রয়েছে। তার পরেও নারী ও শিশুরা ঘরে-বাইরে সর্বক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বর্তমান সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও, পরিস্থিতি বিশ্লেষণে নারী ও শিশুর প্রতি ধর্ষণের মতো সহিংসতার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার সংখ্যা অতি নগণ্য। যে কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে বৈ কমছে না। নির্যাতনের শিকার হয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। প্রতিটি ঘটনা সারাদেশে সাড়া জাগিয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্তই, মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও আইনি কাঠামোতে। আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে কঠোর আইন করে। যার মধ্যে থাকবে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড। এখানে রাজনৈতিক ভেদাভেদ থাকবে না, রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রের মনে রাখতে হবে- ধর্ষক ও যৌন হয়রানিকারীদের কোনো পরিচয় নেই, তাদের একটাই পরিচয় তারা বিকৃত মানুষরূপী জানোয়ার।
এ অবস্থায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ৯টি দাবী তুলে ধরেন নারী নেত্রীরা। তাদের দাবীগুলো হলো- (১) নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। (২) উচ্চ আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে। (৩) বিচার চলাকালে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিবারের নিরাপত্তা, চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। (৪) নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় সাক্ষী প্রমাণ প্রক্রিয়া যুগোপযোগী করতে হবে। (৫) হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে পারিবারিক নির্যাতন আইন। (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ সফল করতে হবে। (৬) ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। (৭) ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। (৮) যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে চিহ্নিত সন্ত্রাসী বখাটেদের জামিন না পাওয়া আইন করতে হবে এবং (৯) সর্বপ্রকার বৈষম্যমূলক আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আইন সংশোধন করতে হবে।
সবশেষে প্রশ্ন হলো- দেশে এত ধর্ষণ হচ্ছে কেন? তা রোধের উপায় কি? ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনে আগে আমাদের মনমানসিকতা বদলাতে হবে। ধর্ষণ কমাতে হলে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা, মাদকের নেশা, পর্ণো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ গান, যৌন উত্তেজক বই, ম্যাগাজিন, অশ্লীল নাটক, সিনেমা ইত্যাদি থেকে সরে আসতে হবে, এগুলো বর্জন করতে হবে, পর্ণো সাইটগুলো বন্ধ করতে হবে যেন, মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে তা দেখা না যায়।
অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ধর্ষণ রোধের অন্তরায় মনে করছেন মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষত বিক্ষত করছে, তা হাল আমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই আন্দাজ করা যায়। জঘণ্যতম নিন্দনীয় ঘটানোর পিছনে দায়ী সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, যথাযথ শিক্ষার অভাব, মাদকে আসক্ত, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আকাশ সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী বিস্তার, প্রযুক্তির অপব্যবহারে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধ বাড়ছে।
ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগই নিম্নবর্গের, তারা সম্ভবত ভয়ে চুপ থাকে। তাদের ধারণা আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। এ মানসিকতার জন্য ধর্ষকরা পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে গেছে। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদির নেতিবাচক মানসিকতার বিস্তৃতি ঘটেছে। সমাজ থেকে মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, ভক্তি, শ্রদ্ধা, প্রেম, ভালোবাসা। যার কারণে আমাদের গঠনমূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সমাজ ক্রমান্বয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চিন্তা চেতনায় বাসা বেঁধেছে অসহায়ত্ব। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। আর তার জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। সমাজের সবাইকে এক হয়ে এ ধরনের হীন কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সমাজের সবাই সচেতন হলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। পাশাপাশি যাতে কঠিন শাস্তি পায় সে দিকটাও নিশ্চিত করতে হবে এবং ধর্ষকদের শাস্তির বিষয়গুলোও প্রচার করা দরকার গণমাধ্যমে, যাতে কেউ এই হীন কাজ না করার সাহস না দেখায়। পাশাপাশি পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়ের মতো জায়গাগুলোতে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার করা উচিত। এছাড়া লিফলেট, ব্যানার, পোস্টারের মাধ্যমেও সচেতনমূলক ক্যাম্পেইন চালানো উচিত। পরিশেষে আমরা যদি সভ্যমানুষের অংশ হিসেবে নিজেদের ভাবি, তবে আমাদের এক্ষুণি ধর্ষক ও উত্ত্যক্তকারীদের আইনি এবং সামাজিকভাবে রুখতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।