লটারি পদ্ধতির ভর্তিতেও জালিয়াতি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৫২:৩২ অপরাহ্ন
![লটারি পদ্ধতির ভর্তিতেও জালিয়াতি লটারি পদ্ধতির ভর্তিতেও জালিয়াতি](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2021/01/sylheterdak-5-768x406.jpg)
অধ্যাক্ষ প্রাণ কান্ত দাশ
সুদীর্ঘ কাল ধরে দেশের প্রসিদ্ধ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলাতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি করা হয়ে থাকে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে এই ভর্তি পরীক্ষায় অসচ্ছতা লক্ষ্য করা যায়। তাই সরকার এই অসচ্ছতা দূর রকার লক্ষ্যে ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে প্রবর্তন করেছেন ডিজিটাল লটারি পদ্ধতি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই পদ্ধতিকে একটি ভাগ্যনির্ভর পদ্ধতি বলেই মনে হয়। ধারণা করা হয়, এখানে হয়ত কারো কোন প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ নেই। এটা সম্পূর্ণরূপেই মানুষের ধরা ছোঁয়ার| বাহিরে। এই পদ্ধতিতে যে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে স্বচ্ছতার সাথে ভর্তির রেজাল্ট বের হয়ে আসে-তাতে কারো কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই এই পদ্ধতির মধ্যেও এক ধরনের প্রতারণা স্পর্শ করলো। ধরা পড়লো বড় ধরনের জালিয়াতি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ বৎসর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১০ জন শিক্ষর্থীর নাম ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে ৫৭ বার এসেছে। গত ১৯/১২/২০২২ তারিখের ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ দেখে আমরা রীতিমতো হতবাক। আমাদের দেশের দুর্নীতির কাছে কী শেষ পর্যন্ত ডিজিটাল লটারিও হার মানলো? কারণ আমরা বাঙালিরা যদি মানুষ হতাম তাহলে অন্তত: মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুদের ডিজিটাল লটারির মতো একটি ভাগ্য পরীক্ষার ভর্তি প্রক্রিয়ায় এমন জালিয়াতি করা হতো না। অন্য শিশুদের ভাগ্য ছিনিয়ে এনে নিজের শিশু সন্তানকে প্রতারণার মাধ্যমে ভর্তি করার হীন চেষ্টা করা হতো না। তাইতো কবিগুরু যথার্থই বলে গেছেন-
‘সাত কোটি মানুষেরে/হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছো বাঙালি করে/ মানুষ করো নি।’
ঐ তারিখের পত্রিকাটিতে সবিস্তারে আরো বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে প্রকাশিত ডিজিটাল লটারির ফলাফলে ১০ শিক্ষার্থীর নাম ৫৭ বার এসেছে। এর মধ্যে মেধা তালিকায় ৪৩ বার ও অপেক্ষমাণ তালিকায় এসেছে ৩৩ বার। শিক্ষর্থীদের জন্ম নিবন্ধন নম্বরের মাঝের কয়েকটি সংখ্যা পরিবর্তন করে অনলাইনে আবেদন করায় এমন ফলাফল এসেছে।
সম্প্রতি মাউশি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, গভ: মডেল গার্লস হাইস্কুল ও সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির লটারির ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এই ফলাফলে এমন জালিয়াতি ধরা পড়ে।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জুলফিকার হোসেন বলেন, মাউশি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত সব প্রধান শিক্ষকের নিকট পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত হলো, যারা জন্ম নিবন্ধন নম্বর ছল চাতুরীর মাধ্যমে পরিবর্তন করে একাধিকবার আবেদন করেছে, যাচাই-বাছাইয়ে জালিয়াতি ধরা পড়লে তাদের ভর্তি বাতিল করা হবে।
অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফরিদা নাজমিন বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ডিজিটাল লটারি পদ্ধতিতে ভর্তির ফলাফলে অনেকের নাম একাধিকবার এসেছে। এ জন্য অভিভাবকরাই দায়ী। ভর্তির ফলাফলে যাদের নাম একাধিকবার এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতারণা করে আবেদন করা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবে না।
ভর্তির ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির লটারির ফলে এক শিক্ষার্থীর নাম ১১ বার এবং আরো দুই শিক্ষর্থীর নাম ৮ বার করে এসেছে। এর মধ্যে প্রথম শিক্ষার্থীর নাম মেধা তালিকায় ৪ বার এসেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিক্ষর্থীর নাম মেধা তালিকায় এসেছে পাঁচ বার করে এবং অপেক্ষমাণ তালিকায় এসেছে তিন বার। গভঃ মডেল গার্লস হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তির লটারির ফলাফলে এক শিক্ষর্থীর নাম ১৪ বার এবং আরেক শিক্ষার্থীর নাম এসেছে ৫ বার। এর মধ্যে প্রথম শিক্ষার্থীর নাম মেধা তালিকায় ১০ বার এবং অপেক্ষমাণ তালিকায় ৪ বার করে এসেছে। দ্বিতীয় শিক্ষার্থীর নাম মেধা তালিকায় এসেছে পাঁচ বার।
শহরের সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ জন শিক্ষার্থীর নাম ৪৩ বার এসেছে। এর মধ্যে এক শিক্ষার্থীর নামই এসেছে ১৯ বার। এর মধ্যে মেধা তালিকায় এসেছে ৩০ বার ও এক শিক্ষার্থীর নাম অপেক্ষমাণ তালিকায় এসেছে ১৩ বার।
একাধিকবার নাম আসা শিক্ষার্থীদের বাবা ও মায়ের নাম একই থাকলেও মুঠোফোন নম্বরের ভিন্নতা রয়েছে। জন্ম নিবন্ধন নম্বরের ১৭ সংখ্যার মধ্যে প্রথম ৯টি ও শেষের ৪টি থেকে ৫ সংখ্যা অপরিবর্তিত রেখে মাঝের সংখ্যাগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে।
এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ডিজিটাল লটারি পদ্ধতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করলো কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ মানুষ। তাই ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিকে আর কেহ যাতে বিতর্কিত করতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যাতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ভাগ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা উচিত, যাতে কেহ কারো ভাগ্য ছিনিয়ে নিতে না পারে। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা বাস্তবায়িত হোক, দলমত নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষ এর সুযোগ ভোগ করুক- এটাই সচেতন নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষক, তাজপুর কলেজ।