চিঠিপত্র ডাক বিভাগের সেবার মান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:৫২:৩০ অপরাহ্ন

মো. আব্দুল ওদুদ
যুগ যুগ ধরে আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল চিঠি। সব ধরনের যোগাযোগ-কুশল জানার ভাব বিনিময়সহ সার্বিক প্রয়োজনে চিঠির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। চিঠির কোন বিকল্প ছিল না। মনের কথা, প্রাণের কথা, ভাব-চিন্তার কথা প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন চিঠি। চিঠিতে প্রকাশ পেত মানুষের তাবৎ মনের নানা কথা। পরিবার পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ-প্রয়োজন মেটাত চিঠি। আমাদের সাহিত্যে চিঠিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য গল্প, উপন্যাস। ছিঠি ছিল আমাদের জীবনেরই অংশ বিশেষ। সেই চিরচেনা চিঠি কেবল উপেক্ষিত নয়; প্রায় বিলুপ্তির পথে। চিঠির আবেদন-গুরুত্ব সবই ফুরিয়েছে। চিঠি লিখে আর সময় অপচয় করে না। অথচ চিঠি লেখায় দক্ষতা ও পারদর্শিতার জন্য অনেকে চিঠি সাহিত্যিকের মর্যাদা পর্যন্ত পেতেন। তার কাছে ছুটে যেত কত মানুষ কেবল চিঠি লেখানোর জন্য।
চিঠি লেখার জন্য বিশেষ ধরনের নীল কাগজের প্যাড পাওয়া যেত। সেই প্যাডের উপরে পাখির ঠাটে চিঠির খাম মুদ্রিত এবং পাশে ছাপার অক্ষরে লেখা থাকতো ‘ভুলোনা আমায়’, মনে রেখো ‘যাও পাখি বল তারে সে যেন ভুলে না মোরে’ ইত্যাদি নানা কথা। যাদের সঙ্গতি ছিল তারা সেসব নীল প্যাডের কাগজে চিঠি লিখে প্রিয়জনকে পাঠাত। এ যেন এক হারানো পৃথিবীর হারানো স্মৃতি। চিঠির ভাষা ও শব্দ প্রয়োগে সৃজনশীলতা নিয়ে একরকম প্রতিযোগিতা পর্যন্ত ছিল। আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও পত্র বন্ধুদের সঙ্গে পত্রালাপের এক সংস্কৃতিও ছিল। চিঠি লেখার মধ্য দিয়ে ভাষা জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ ছিল। ভাষা জ্ঞান, শব্দ গঠন ও প্রয়োগে চিঠির ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি চিঠি অনেকবার খসড়া করে তবেই চূড়ান্ত করে প্রাপকের কাছে পাঠানো হতো। চিঠির সর্বজনীন ব্যবহার যেমন ছিল, তেমনি ছিল চিঠির রোমান্টিক আবেদন। মানুষের হাসি-কান্না, আনন্দ, দুঃখ, বিরহ-বেদনা, শোকবার্তা সবই বয়ে আনত চিঠি। হাল আমলের মোবাইল ফোন পুরোপুর দখলে চিঠির স্থানটি।
প্রিয়জন বা নিকটজনের সংবাদ জানতে চিঠির জন্য ব্যাকুল হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা আর দিতে হয় না। প্রেরক এবং প্রাপক কাউকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রহর গুনতে হয় না। প্রয়োজন হয় না সময়ক্ষেপণের অধীর প্রতীক্ষার। তাৎক্ষণিকভাবে কাক্সিক্ষত যে কার সঙ্গে মুহূর্তে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করা যায়। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এই যান্ত্রিক যুগে সব কিছুই মানুষের নাগালে।
আমাদের চিরচেনা চিঠির সংস্কৃতি এখন সোনালী অতীত। বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় এত ইতিবাচকের পাশাপাশি নেতিবাচক দিকটি যে নেই, তা কিন্তু নয়। নেতিবাচক দিকটি কি আমরা বিবেচনা করছি? আজকের প্রজন্ম মোবাইল, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট সংস্কৃতিতে ডুবে আছে। তাদের মেধা ও মনন বিকাশে যান্ত্রিকতার বিরূপ প্রভাব অস্বীকার করি কীভাবে? চিঠি লেখার অনভ্যস্ততায় কর্মজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে চিঠি লিখতে তাদের যে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না এই সত্যটি কি অস্বীকার করা যাবে? যান্ত্রিকতার ভিড়ে তাদের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও জ্ঞানার্জনের পাঠাভ্যাস কি সৃষ্টির উপায় আছে? সেটা কি ভাবনার কারণ নয়?
আমাদের চিরচেনা সংস্কৃতি মাত্র বছরের ব্যবধানে হয়েছে অচেনা এবং অপাঙক্তেয়। আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন ও ইতিহাসভিত্তিক রচনা আজকের প্রজন্মকে তেমন আকর্ষণ করে না, এটা কি ভাবনার বিষয় নয়? সমষ্টির বাইরে এসে তারা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। পাস-টাস করে ঠাস-ঠাস উপরে উঠে যাওয়ার প্রবণতায় ব্যস্ত। সেই সিঁড়িটির খোঁজেই তারা অধীর ব্যস্ত, যে সিঁড়িটি তাদের ব্যক্তিগত উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দেবে। সমষ্টিগত চিন্তা তাদের চিন্তা জগতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একটি জাতির সমষ্টিগত উন্নতির বিপরীতে চলছে ব্যক্তিগত উন্নতির প্রতিযোগিতা সামষ্টিগতভাবে আমরা রয়ে যাচ্ছি অনগ্রসর।
চিঠির ব্যাপক আদান-প্রদানে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ডাক বিভাগের। কর্মব্যস্ত ডাক বিভাগও আজ আর অতীতের মতো কর্মমুখর নেই। চিঠি লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ডাক বিভাগের কর্ম পরিধিও কমে গেছে। ডাক বিভাগ এখন কর্মমুখর সচল কোন প্রতিষ্ঠান নয়। অচল এবং অলস এক রাষ্ট্রীয় অপচয়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত। যা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সচল অবস্থায়ও প্রতিষ্ঠানটির কোন জবাবদিহিতা ছিল না। প্রাপকের চিঠি বেহাত হওয়ার মূলে ছিল চিঠি বিলি বণ্টনে নিয়োজিত ডাক পিওনদের অনৈতিক কীর্তি ও দায়িত্বে অবহেলা। একান্ত ব্যক্তিগত চিঠির ক্ষেত্রে ডাক পিওনদের উপঢৌকন দিয়ে হাতে রাখতে হতো। চিঠি যেন খোয়া না যায় কিংবা বেহাত না হয় সেজন্য ডাকপিওনদের মাসোহারা পর্যন্ত দিতে হতো। চিঠির প্রেরক বা প্রাপক মেয়ে হলে চিঠির গোপনীয়তা ফাঁসে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে রীতিমতো অসম্মানজনক অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো।
সঙ্গত কারণেই ডাক বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা না রাখার উপায় ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থার অভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও ডাক বিভাগের ওপরই বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হতো। আজকে আধুনিক প্রযুক্তির আগমনে ই-মেইল, ফ্যাক্সে চিঠি যেমন প্রেরিত হয়, পাশাপাশি হয় বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। বেসরকারি কুরিয়ার ডাক বিভাগের বিকল্প হিসেবে ডাক বিভাগের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে, ডাক বিভাগের বিকল্প হিসেবে মানুষের আস্থাও অর্জন করেছে। চিঠি, ডক্যুমেন্ট, পার্সেল, অর্থ প্রেরণ সহ ডাক বিভাগের তাবৎ কর্মের বিকল্প হিসেবে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো মানুষের কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠেছে। এতে ডাক বিভাগের কর্মপরিধি সংকুচিত এবং হুমকির মুখে এখন। স্বেচ্ছাচারিতার মাশুল এখন গুণতে হচ্ছে খোদ ডাক বিভাগকেই। রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের দ্বিগুণ খরচে মানুষ বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসে নির্ভর হয়ে উঠেছে। বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বিশাল ডাক বিভাগ এখন অন্তিম প্রহর গুণছে। ডাক বিভাগের সেবার মান নেই বলেই মানুষের আস্থা-ভরসা তারা হারিয়েছে। পাঁচ টাকা খরচে একটি চিঠি নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপকের হাতে আদৌ পৌঁছবে তার নিশ্চয়তা নেই। অথচ ১৫ টাকা খরচে বেসরকারি কুরিয়ার পর দিনই নির্দিষ্ট প্রাপকের হাতে পৌঁছে দেয়।
আমাদের অতীতের কোন সরকারই ডাক বিভাগের আধুনিকায়ন সহ সংস্কার তেমন করেনি। সেকেলে ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি যুগোপযোগী হয়নি, হয়নি তেমন আধুনিকও। তাই যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারেনি। ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকার ডাক বিভাগের উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাস শেষে বেতন নিয়মিতই পাচ্ছেন। কিন্তু তাদের আসেনি দায়িত্বশীলতা। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার কোন আগ্রহই তাদের নেই। দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা অতীতমুখী। ডাক বিভাগ কেবল অলাভজনকই নয়, রাষ্ট্রের মস্ত বড় বোঝাও বটে। এই বোঝা সরকার কত দিন বইবে তা নিকট ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
লেখক : প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কলামিস্ট।