আমরাও স্বপ্ন দেখি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:৪৫:২৪ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
এপিজে আব্দুল কালাম নিজের দেশ ও জাতিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, যে স্বপ্ন ঘুমন্ত অবস্থায় নয় জাগ্রত অবস্থায়। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন একটি দেশের যে দেশ হবে পরাক্রমশালী, যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র, হিংসা , চুরি ডাকাতি, ছিনতাই, দাঙ্গাবাজি থাকবে না। থাকবেনা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি। দেশের প্রতিটি মানুষই নূন্যতম সুযোগ সুবিধা পাবে। স্বপ্ন আমরাও দেখি কিছুটা হলেও বাস্তবায়নের চিন্তা করি।
একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আমেরিকা, ইংল্যান্ড কিংবা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক জায়গাতেই পিছিয়ে আছি, যার মধ্যে অন্যতম হল সঠিক পরিকাঠামোর অভাব। বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সঠিক পরিকাঠামোর থেকে বেশি অন্তরায় হল আমাদের মানসিকতা, চিন্তাভাবনা কাজের উপযুক্ত সঠিক পরিবেশের অভাব।
সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, দেশের বেশির ভাগ মানুষই আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদানের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, সমাজের বেশির ভাগ মানুষই বিশ্বাস করে সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে সঠিক মানের পড়াশোনা হয় না বা দেওয়া হয় না। আবার, একই ব্যক্তি স্কুলের শিক্ষক হয়েও স্কুলের পরিবর্তে নিজ বাড়িতে ব্যক্তিগতভাবে টিউশন দানের সময় যথেষ্ট যত্ন করে ভালোভাবে পড়ান। একইভাবে মানুষ মনে করে, একজন ডাক্তার সরকারি হাসপাতালের পরিবর্তে ব্যক্তিগতভাবে নিজস্ব চেম্বারে কিংবা নার্সিং হোমে রোগীকে মনোযোগ সহকারে দেখেন এবং উন্নততর চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করেন। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার, জনগণ জানে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোথায় কী পরিকাঠামো আছে এবং সেখানে থেকে কী কী পরিষেবা পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে সেই ছোটকাল থেকে শুনে আসছি বাংলাদেশ জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”। ভারতের সবার প্রিয় প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ভারতরত্ন ড. এপিজে আব্দুল কালাম আপামর দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখা শিখিয়েছিলেন তাঁর ভিশন-২০২০ এবং প্রেরণাদায়ী বক্তব্য ও আলোচনার মাধ্যমে। যে স্বপ্ন মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় নয়, জাগ্রত অবস্থায় দেখে। যে স্বপ্ন মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। নিজের দেশ ও জাতিকে উন্নত অবস্থায় দেখার স্বপ্ন। আমরা স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশে পরিণত হবে। যেখানে দারিদ্র, ক্ষুধা, দাঙ্গা, হিংসা, মারামারি ইত্যাদি থাকবে না। দেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পাবে। কিন্তু সেই দিন কবে আসবে? ছাত্রাবস্থা থেকে প্রায়শই এ-বিষয় নিয়ে ভাবতাম এবং এর কারণ খোঁজারও চেষ্টা করতাম।
বিভিন্ন হাসপাতালের মান এবং সেখানে কী লেভেলের চিকিৎসা বা পরিষেবা পাওয়া সম্ভব মানুষ তা ভালো করেই জানে। যেমন বিশ্বনাথ হাসপাতাল – সর্দি, জ্বর, ছোটোখাটো অপারেশন ইত্যাদি চিকিৎসার জন্য পরিকাঠামো আছে এবং চাইলে একজন রোগী এইসব পরিষেবা ওখান থেকে পেতে পারে। এখানে কিডনি কিংবা লিভার প্রতিস্থাপন করা যাবে এমন আশা কেউ করে না। কিন্তু সমস্যা হল, যে হাসপাতাল কিংবা যে প্রতিষ্ঠান বর্তমান পরিকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে যে লেভেলের বা গুণমানের পরিষেবা প্রদানে সক্ষম, মানুষ মনে করে সেই মাত্রার পরিষেবা সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে আবার পরিষেবা প্রদানে বৈষম্য দেখা যায়। একই অবস্থা প্রায় বেশির ভাগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের, যেমন- থানা, অফিস, আদালত, ইত্যাদি। ফলে বেশিরভাগ মানুষ বর্তমান সিস্টেমের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা সিস্টেমের উপর আস্থা হারানোর ফলে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন যা মানুষের কর্মদক্ষতা, কাজ করার মানসিকতা এবং সর্বোপরি সামগ্রিক আউটপুট কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে মানুষের মনে এক বিরূপ ধারণা হয়ে গেছে যে পর্যাপ্ত টাকা বা সম্পদ থাকলে বিভিন্ন পরিষেবা কিনে নেওয়া সম্ভব অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়েও প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিষেবা পাওয়া সম্ভব। এর ফলে মানুষ অর্জিত অর্থের খুব কম অংশই নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে যায় করে। অন্যদিকে, সরকার কর্তৃক কোনও সংগঠিত বিমার ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ কোনও আকস্মিক জরুরি অবস্থার কথা ভেবে বেশি বেশি করে ধনসম্পদ উপার্জন ও জমিয়ে রাখার উপ জোর দেয়। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের তাড়নায় মানুষ অনেক সময় বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে কিংবা দুর্নীতি জেনেও মানুষ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পিছনে ছোটে। অন্যদিকে, সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সাপোর্ট নিয়ে আরও বেশি বেশি দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়ে যায়। এমনিতেই আমাদের দেশের বিরাট সংখ্যক লোক গরিব। তারা অর্থের অভাবে কিংবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। অন্যদিকে, দৈনন্দিন জীবনযাপনে আপস করা এবং জেনেশুনেও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের পিছনে ছোটার ফলে মানুষ হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। মানুষের মধ্যে অন্যের জন্য চিন্তা করা, কারোর বিপদে পাশে দাঁড়ানো চৎধঃঃ, ইত্যাদি কমে আসছে কিংবা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির ভাবনা থেকেও মানুষ পিছিয়ে আসছে।
গরিব বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীরও একই হাল। অথচ ক্রয়ক্ষমতার বিচারে জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা অন্য যে-কোনো উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় কোনও অংশে কম নয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে একজন প্রফেসরের বেতন ৭৫ হাজার টাকা থেকে ১লাখ টাকা। অন্যদিকে, ইউরোপে একজন প্রফেসারের বেতন ৩.০০-৫.০০ লাখ টাকা। বাংলাদেশে ১-২.৫ লাখ নিয়ে যত জিনিস কেনা যাবে ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় ৩.০০-৫.০০ লাখ টাকা দিয়ে তার চার ভাগের এক ভাগও কেনা যাবে না। অথচ,ঐ সকল দেশের মানুষের জীবনশৈলী আমাদের দেশের থেকে অনেক উন্নত। ঐ সকল দেশে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের যেমন- স্কুল-কলেজ, হসপিটাল, থানা-পুলিশ, অফিস-আদালত ইত্যাদির উপর মানুষ যথেষ্ট আস্থাশীল। একই সঙ্গে সরকারও মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন করার ফলে প্রত্যেক মানুষই তাঁর ভবিষ্যৎ কিংবা কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য আলাদা করে ভাবতে হয় না। সে নিশ্চিন্তে যথেষ্ট আরামদায়ক জীবনযাপনের জন্য নিজের -আয়ের প্রায় সবটাই নির্দ্বিধায় খরচ করতে পারে। ফলে ১০০ শতাংশ মনোযোগ নিয়ে নিজের কাজ করে এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে এবং পারিপার্শ্বিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে প্রায়শই হতাশায় ভোগেন এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ উদ্যোগ কিংবা মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারে না। ফলে দেশ ও জাতির অগ্রগতি সামগ্রিকভাবে ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতির বদল না-করে শুধু পরিকাঠামোগত বদল করে উন্নয়নের গতি পরিবর্তন সহজ হবে না।
অতএব বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে পরিকাঠামোগত উন্নতির আগে যেটা দরকার সেটা হল মানুষের তথা দেশের প্রতিটি নাগরিকের মনে সিস্টেম কিংবা বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা, যাতে মানুষ কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ পায়। নিজ নিজ কর্মক্ষতার ১০০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারে এবং দেশের বর্তমান অবকাঠামোর ১০০ শতাংশ সদ্ব্যবহার করতে পারে। তবেই দেশ দ্রুত উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বাড়ানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারকে কাজ করে যেতে হবে। এজন্য যা দরকার তা হল সরকারের সদিচ্ছা- দুর্নীতিমুক্ত সরকার ও সমাজ প্রতিষ্টা এবং সঠিক পরিকল্পনা ও তার সফল বাস্তবায়ন। এজন্য সরকারকে রাজনৈতিক দল এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমান অবকাঠামোর আমূল বদল না করেও মানুষের কর্মদক্ষতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ও সঠিক কর্মসংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের স্বপ্ন ‘বাংলাদেশ আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’-এর দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।