ভেজালবিরোধী সামাজিক আন্দোলন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:০১:৫৩ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
ভেজাল পণ্যে সয়লাব বাজার। খাদ্যপণ্য, কসমেটিকস, জ্বালানি তেল, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে শিশুর ব্যবহার্য ডায়াপার, কোনো কিছুতেই আস্থা রাখতে পারছেন না ভোক্তারা। নকল ও ভেজাল পণ্য কিনে পদে পদে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা। মানহীন খাদ্য ও কসমেটিকস পণ্য বাড়িয়ে তুলছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। নকল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনা। কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। ভেজাল জ্বালানি তেলে আয়ু কমছে যানবাহনের। দূষণ ঘটছে পরিবেশের। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) ও বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর নামে তিনটি সরকারি সংস্থা মাঠে থাকলেও রোধ করতে পারছে না ভেজালের বিস্তার। দেশে সব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিএসটিআই ৪ হাজার ৯৫টি পণ্যের মান প্রণয়ন করলেও ২২৯টি পণ্য তাদের বাধ্যতামূলক তালিকায় রয়েছে। ৯৪ শতাংশের বেশি পণ্য তাদের নজরদারির বাইরে। মান নির্ধারণ করা ৬ শতাধিক কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মধ্যে বাধ্যতামূলক নজরদারির তালিকায় আছে মাত্র ৮৮টি। বাধ্যতামূলক তালিকায় থাকা পণ্যগুলোরও সঠিক তদারকি হচ্ছে না। ফলে মানহীন ও ভেজাল পণ্যে ছেয়ে গেছে বাজার। ভেজাল খাদ্যে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ। বিস্কুট, পাউরুটি, চানাচুরসহ বিভিন্ন বেকারি পণ্যে স্পষ্টভাবে বাংলায় উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, পুষ্টি ও উৎপাদন উপকরণের তথ্য ও উৎপাদকের ঠিকানা লেখা বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত। এ নিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বেকারি পণ্য আমদানিকারক, বিক্রেতা ও উৎপাদনকারীদের সতর্ক করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকা পাউরুটি, বনরুটি, কেক মেয়াদ শেষে আবারও ফেরত যাচ্ছে বেকারিতে। নতুন মেয়াদ লাগিয়ে ফিরে আসছে দোকানে। কসমেটিকস পণ্যের মেয়াদ শেষে কাগজের স্টিকার লাগিয়ে বাড়ানো হচ্ছে মেয়াদ। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে আনা বিদেশি পণ্য বলে দেদার বিক্রি হচ্ছে নকল কসমেটিকস ও খাদ্যপণ্য। ভেজালবিরোধী অভিযান নেই বললেই চলে। রাজধানী ঢাকায় এমন এলাকাও রয়েছে যেখানে গত পাঁচ বছরের মধ্যেও ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান দেখেনি স্থানীয়রা। রাজধানীর বাইরে ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না।
কাঠের গুঁড়া আর ময়দা দিয়ে হচ্ছে পাউরুটি-কেক, সুস্বাদু ঘি তৈরি হচ্ছে সয়াবিন ও ডালডা দিয়ে, মিনারেল ওয়াটারের নামে ট্যাপের পানি- এভাবেই সারা দেশে চলছে ভেজালের জমজমাট ব্যবসা। সেমাই, সরিষার তেল, গুড়া মসলা, সাবান, শ্যাম্পু, কসমেটিকস, গুড়া দুধ, শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। নকলের ভিড়ে আসল পণ্য চেনাই দায় হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন নামিদামি ব্রান্ডের মোড়ক হুবহু নকল করে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এই ভেজাল সিন্ডিকেট। অভিযান, গ্রেফতার, সাজাতেও থামছে না ভেজাল পণ্যের দৌরাত্ম্য। পানি বোতলজাত করে ‘মিনারেল ওয়াটার’ নামে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া অপরিপক্ক ফল পাকাতে, মাছ সংরক্ষণে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষিপণ্যেও বিষাক্ত রাসায়নিক (কেমিক্যাল) মেশানো হচ্ছে। নকল কারখানার মালিক ও ভেজাল পণ্য বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক সরকারি সংস্থা অভিযান চালালেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও কোনো নজির নেই। ধরা পড়ার পর জরিমানা ও কারখানা সাময়িক বন্ধ হলেও একই ধরনের অপকর্মে তারা আবার লিপ্ত হয়। গ্রাম পর্যায়ের মুড়ি প্রস্তুতকারক থেকে শুরু করে কিছু ব্র্যাণ্ড প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যেও ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে অভিযানে।
মাছ, শাক-সবজিতে ফরমালিন, বিষাক্ত জেলি, প্লাস্টিক ও কীটনাশক, ভোজ্যতেলে অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট, মসলায় রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মুড়িতে ইউরিয়া, বোতলজাত পানিতে কলেরার জীবাণু, গরুর দুধে পাউডার ও পানির মিশ্রণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি ও বেকারি পণ্য তৈরি, হোটেল রেস্তোঁরার খাবারে বাসি-পচা ও পোড়া তেল ব্যবহারসহ সব খাবারেই প্রতিনিয়ত ভেজাল মেশানো হচ্ছে।
ভেজাল খাবারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাহারি শরবত, রকমারি খাবারে ‘ফুড গ্রেড’র নামে ব্যবহার করা হচ্ছে কারখানায় ব্যবহৃত রং। দীর্ঘদিনের পোড়া তেলে চলছে হোটেল, রেস্টুরেন্টে রান্না। এসব রাসায়নিক উপাদানে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। কিডনি, লিবার ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বাইরে থেকে কেনা খাবারে বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর উপাদান মেশানো হয়। শরীরের জন্য ক্ষতিকর রং, প্রিজারভেটিভ, ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। মুখরোচক করার জন্য অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা হয়। এসব উপাদান মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে। লিভারের সমস্যার পাশাপাশি কিডনির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এসব খাবার। অনেক উপাদান দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত তৈরি করে এবং দুরারোগ্য রোগ জন্ম দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ যেমন জনস্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। খাদ্যের ভেজাল তার চেয়েও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। একদিকে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ করে তুলেছে, অন্যদিকে ভেজাল খাদ্য কিনে মানুষ প্রতারিত ও জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো সচেতন মানুষের পক্ষেই স্বস্থির সাথে কোনো খাদ্য খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো খাবার পুষ্টির বদলে মানুষকে আরও করছে রোগাক্রান্ত। খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য এ মুহূর্তে এক নম্বর হুমকি। খাদ্যপণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে যা অবশ্য করণীয় তা হচ্ছে:-
(১) সরকার প্রণীত ভেজাল বিরোধী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন করা। (২) ভেজাল বিরোধী অভিযান সর্বদা অব্যাহত রাখা। (৩) ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে ভেজালবিরোধী বক্তব্য বারবার প্রদান করা। (৪) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে খাদ্যপণ্যে ভেজালবিরোধী পাঠ বারবার উপস্থাপন করা। সপ্তাহে কমপক্ষে একবার। যাতে শিক্ষার্থীরা সেই ভেজাল খাদ্যপণ্যের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থাকে। (৫) ভেজালের বিরুদ্ধে বাজার কমিটি গঠন করা। বাজার কমিটি কর্তৃক বারবার তদারকি করা। (৬) খাদ্যপণ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
লেখক : প্রাবন্ধিক।