শতবর্ষী এক রাজনীতিকের প্রয়াণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:১৯:৪০ অপরাহ্ন
শফিকুল ইসলাম
নিজ গ্রামে জানাজা শেষে হাজারো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পারিবারিক গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন দিরাই পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হাজ্বী আহমদ মিয়া। শতাব্দির সাক্ষী বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ তার দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ভাটিবাংলার শীর্ষ রাজনৈতিক ও জাতীয় নেতা মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক এমপি নাছির উদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে করিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান হিসেব দায়িত্ব পালন করেন। বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর হাজ্বী আহমদ মিয়া প্রথমে ন্যাপ, পরবর্তীতে একতা পার্টি ও গণতন্ত্রী পার্টির দিরাই থানা শাখার সভাপতি ছিলেন দীর্ঘ দিন। শেষ জীবনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি থেকে।
রাজনৈতিক পরিমন্ডল ছাড়াও সামা
জিক এবং ব্যবসায়িক অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল সরব। তিনি একজন স্পষ্টভাষী ন্যায়বিচারক হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। সততা এবং নীতিতে তিনি ছিলেন অটল। দিরাই বাজারে তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দির বেশী সময় ধরে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা করে আসছিলেন, পাশাপাশি দীর্ঘদিন দিরাই বাজার মহাজন সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অনেকের মতে তিনি দিরাই বাজারের সবচেয়ে প্রবীন ব্যবসায়ী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যিনি নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসতেন। দোকানে বসা অবস্থায় তিনি মানুষকে ডেকে চা পান করাতেন কুশলাদি জানতেন। এ ভাবেই তিনি মানুষের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিলেন। সেই সাথে তার দোকানটি দিরাই বাজারের রাজনীতির আঁখড়া হিসেব গন্য হতো ।
ভাটি অঞ্চলের এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং সমাজ হিতৈষী আহমদ মিয়া যিনি আমার আজন্ম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। যার সান্নিধ্য লাভে আমি সব সময় পুলকিত হতাম। তাকে নিয়ে আজ অনেক কথাই মনে উকি দেয়। দেশ থেকে মাঝে মধ্যে আমাকে ফোন করে খবর নিতেন আর দোয়া দিতেন। যেভাবে তার যুক্তরাজ্য প্রবাসী চার ছেলে-মেয়ে অনুজ প্রতীম আজমল হোসাইন, তপু আহমদ, সুমি এবং সুরাইয়ার খবর নিতেন। বাদ বাকী ছেলে মেয়েদের সকলে বিশেষ করে আনোযারা আপা, আম্বিয়া বেগম, মাজেদা বেগম, শামীমা বেগম ও আসলাম হোসেইন পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে দেশে বসবাস করছেন। তার মধ্য অনেক গুণ ছিল। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনের অধিকারী জনদরদী এই ব্যক্তিত্ব দিরাই পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের ভাইস চেয়ারম্যান। বলতে গেলে তিনি ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তীতূল্য। ঐতিহ্যবাহী দিরাই বাজারের প্রবীন এই ব্যবসায়ী যার হাত দিয়ে দিরাই শাল্লা তথা ভাটি অঞ্চলের খাল বিল নদী নালা থেকে মুক্তার (চবৎষং) ভান্ডার সংগ্রহ হয়ে সারা ভারত বর্ষে বিক্রি হতো। তার এই পরিচয়টি দিরাইর নতুন প্রজন্ম না জানলেও প্রবীণেরা অবশ্যই জানেন। ‘মুক্তা’ ব্যবসার চারণ ভূমি ছিল ভাটিবাংলা। সে সময়ে গ্রামাঞ্চলে অনেকেই দিন ভর খালে বিলে এই মোতি বা মুক্তা সংগ্রহ করতেন এবং দিন শেষে বাজারে এসে তার কাছে বিক্রি করতেন আর সেই ব্যবসার গল্প শুনতাম তার কাছে। সব পুরানো দিনের গল্পে আর আলাপে তিনি প্রায়শই উল্লেখ করতেন আমার দাদা মরহুম পীর মনির উদ্দীনের কথা। এই এলাকায় যারা ছিলেন এই ব্যবসার অগ্রপুরুষ। আহমদ মিয়া সেই বৃটিশ আমল থেকে কালের সাক্ষী হয়ে আমাদের মধ্য বেঁচে ছিলেন দুদিন আগ পর্যন্ত এবং দিরাইর রাজনীতি আর সামাজিক কর্ম কান্ডে জড়িত ছিলেন আমৃত্যু।
আহমদ মিয়া নিজে স্বল্প শিক্ষিত হলেও তিনি ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষার প্রতি যত্নশীল ব্যক্তি। তিন পুত্র ও ছয় কন্যা সন্তানের সফল জনক। বলতে গেলে ছেলে মেয়েদের সবাই লেখা পড়া করেছেন। তৎকালীন সময়ে নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও তিনি তার মেয়েদের নৌকা করে দিরাই গার্লস স্কুলে আনা নেয়ার ব্যবস্থা করতেন যা আমার নিজের দেখা। শুধু কি তাই মেয়েদের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হাজ্বী আহমদ মিয়া বালিকা মাদ্রাসা’। আশা করি এই প্রতিষ্ঠানটি যুগযুগ ধরে বহন করে চলবে আহমদ মিয়ার কর্মময় জীবনের স্মৃতি। তিনি স্থানীয় সব কটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সময়ে। এছাড়া ও তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিরাই বাজার জামে মসজিদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মসজিদের উন্নতি সাধনে সচেষ্ট হন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন মসজিদটির প্রতিষ্ঠাদের অন্যতম। হাজ্বী আহমদ মিয়া দীর্ঘ নয় বছর পৌর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ নানা জনহিতকর কাজের জন্য তিনি মানুষের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবেন। পরিশেষে আমি মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি, সেই সাথে শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক