সাফা-মারওয়ায় এক রাত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:২৫:০০ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
হজ্ব হলো ইশক ও মুহাব্বতের প্রেম ও ভালোবাসার নাম। হজ্বের প্রতিটি আমলের মাধ্যমে বান্দাকে প্রমাণ করতে হবে যে, সে এখন যুক্তি ও বুদ্ধির খোলস থেকে বের হয়ে এসেছে। সে এখন হৃদয় রাজ্যে এবং প্রেম ভালোবাসার জগতে প্রবেশ করেছে। হজ্বের মূল প্রাণ প্রেম ও ভালোবাসা এবং ইশক ও মুহাব্বত প্রকাশ। আল্লাহর রহমত আমলের বাহার দেখে না, দেখে আমলের বাহানা। মহান আল্লাহ সোবহানাহুতায়ালার অপার করুণায় আমি তৃতীয়বারের মতো উমরা হজ্বের বরকতপূর্ণ সফর করতে সৌভাগ্য হয়েছিল।
উমরাহ শব্দের অভিধানিক অর্থ জিয়ারত তথা দর্শন বা সাক্ষাৎ। শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ হলো বিশেষ পদ্ধতিতে কা’বা ঘরের জিয়ারত করা অর্থাৎ মীকাত বা হিল থেকে ইহরাম বেঁধে বাইতুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করা। উমরা হজ্বকে হজ্বে আসগর বা ছোট হজ্বও বলা হয়ে থাকে। (শরহে-লুলাব) পবিত্র কুরআন ও হাদিসে উমরার অনেক ফজিলত বর্ণিত আছে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ্ব ও উমরাহ পূর্ণভাবে সম্পাদন করো। সূরা বাকারা-১৯৬।
উমরার ফরজ দু’টি ১. মীকাত বা তারও পূর্ব হতে উমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধা। ২. বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা। উমরার ওয়াজিব দুটি। ১. সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সবুজ বাতির স্থানটুকু সা’ঈ (দৌড়ানো) করা। শুধু পুরুষদের জন্য ওয়াজিব। ২. সা’ঈ করার পর হলক (মাথার চুল ন্যাড়া করা) বা ছোট করা ওয়াজীব, ইহরাম হচ্ছে পুরুষদের পোশাকের মধ্যে আছে সেলাই না করা দুই টুকরা সাদা পশমী অথবা সূতী কাপড় যাঁর এক খন্ড পৌঁছানো হয় কোমরে এবং পৌঁছে হাঁটুর নীচে পর্যন্ত এবং অন্য খণ্ডটি আলগাভাবে ঝুলানো হয় কাঁদের পর, আর মাথা খোলা অনাবৃত পূর্ব উমরার নিয়ত করে তালবিয়াহ পড়া এবং বাইতুল্লাহ শরিফের তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার সা’ঈ করার পর মাথার চুল ন্যাড়া করে মুক্ত হওয়া পর্যন্ত অবস্থাকে ইহরাম বলে।
এই যে ইহরাম (পোশাক) যার মূলে রয়েছে রাসূল (স.) এর অতীতের একটি আদেশ এর যুক্তি এই যে, হজ্বের সময় আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার জন্য পৃথিবীর সব জায়গা থেকে মুমিনরা এসে জমায়েত হয়ে একে অপরের অপরিচিত এ অনুভূতি যেনো তাদের মধ্যে না থাকে। জাত ও জাতির মধ্যে ধনী-গরীব কিংবা উচু-নিচুর মধ্যে যেনো ব্যবধান না থাকে। যেনো ওরা সকলেই জানতে পারে ওরা ভাই ভাই। আল্লাহর কাছে সকলই সমান।
তাওয়াফ সাঈতে পুরুষ হাজীদের দেহে রং বেরংয়ের বর্ণাঢ্য পোশাক দেখা যাবে না তিউমিসের লাল তারবুস। মরক্কোবাসীদের জমকালো দামী বার্নাস অথবা মিশরীদের লোহিনের রুচি বিবর্জিত গল্পাবিয়া।
ইহরাম রমণীদের শরীরের অনেকখানি ব্যক্ত করে দেবে এজন্য মহিলা হজ্বযাত্রীরা ওদের স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করে থাকেন। নয়ন প্রীতিকর শিল্পশৈলীর সৃষ্ট সাফা মারওয়া সাঙ্গী করার সময় মিশরীয় রমণীদের গায়ে কালো গাউন আর উত্তর আফ্রিকার রমণীদের পরণে সাদা গাউন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মহিলাদের সাদা, নীল, হলুদ গাউন বা বোরকা মহিলারা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। ভারতীয় মহিলারা ওদের গায়ে সাদা বোরকা এমনি অভেদ্যভাবে আচ্ছাদিত যে, ওদের দেখাচ্ছে চলন্ত তাবুর মতো। নিগ্রো রমণীদের গায়ে ওদের নীল ঢিলে ঢালা পোশাক আর মাথার তালু ঢাকা লাল টুপি। আর ক্ষুত্র পরিপাটি দেহের অধিকারী মঙ্গলীয় মহিলারা বিচিত্র রঙ্গিন প্রজাপতির মতো লঘু পদে হাঁটছে যা দেখে আমি স্রষ্টার সুনিপুণ সৃষ্টি আশরাফুল মখলুকাতের কারুকার্য দেখে অভিভূত হই।
সাফা ও মারওয়ার কেন এত বড় শান? এত বড় সম্মান? কারণ সাফা-মারওয়া আল্লাহর মুহাব্বতের নিশান। অগণিত মানুষের গুঞ্জরণে আল কুরআনের সুমধুর আয়াত উচ্চারিত হচ্ছে। যার অর্থ সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। অতএব যে কেউ কাবাগৃহে হজ্ব কিংবা উমরা করে এ দু’টি পাহাড় তাওয়াফ করলে তাদের কোন পাপ নেই এবং যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকর্ম করে তাকে আল্লাহ পুরস্কার দেন। তিনি সর্বজ্ঞ, সূরা বাকারা আয়াত: ১৫৮। সা’ঈর দোয়ার ধ্বনি সকলের এক এবং অভিন্ন। এতে বুঝা যায় আল্লাহ যেমন নিরাকার, তার কুরআনের ধ্বনিও এক ও অভিন্ন। সাফা-মারওয়া শরীরী প্রদক্ষিণ মানবিক ক্রিয়াকলাপের প্রতীক স্বরূপ এক অভিব্যক্তি। মহান আল্লাহ অশেষ রহমতে সাফা-মারওয়া হেঁটে চলেছি। মিনিটের পর মিনিট চলে যাচ্ছে। আমার হৃদয়ে ক্ষুদ্র ও তিক্ত যা কিছু ছিল তা সবই আমার হৃদয়কে ত্যাগ করতে শুরু করে। আমি দেখতে পাচ্ছি সাফা থেকে মারওয়া আমার চারপাশে শুধু শুভ্রতা আর শুভ্রতা সেই সাথে নারী-পুরুষের এক অন্তহীন স্রোত। সাঙ্গী চলতে থাকলো সাফা ও মারওয়ার শ্বেত পাহাড়ের মাঝে। আমি দৌড়ে পার হই সবুজ আলোর সীমানা। মা হাজেরা শিশু পুত্র ইসমাইলের ব্যাকুলতাকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে। আমি কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম এখন যে জায়গায় জমজম কূপ যেখানে শুয়ে আছেন শিশু ইসমাইল। এই সেই উপত্যকা যেখানে ছিলো একটি মাত্র বুনো সরহা গাছ। তাঁরই ছায়ায় শিশু পুত্র ইসমাইলকে নিয়ে বসে আছেন বিবি হাজেরা। তাঁকে ঘিরে সাঁতরে চলা ঢেউ খেলা করে গরম লুহু হাওয়া। এবং কালো পাহাড়ের পর গাছের চামড়া ঝলসানো আর্দ্রছাড়া আর কিছু নেই। চারিদিকে শুধু ভয়ঙ্কর নীরবতা। যার মধ্যে শুনা যায় না কোনো জীবিত প্রাণীর নিশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত। দিন বিদায় নিচ্ছে উজ্জ্বল রৌদ্র অস্তমিত হচ্ছে। তাঁকে ঘিরে ধরছে কালো কুচকুচে অন্ধকার কালো রাত্রি এবং ধেঁয়ে আসছে উপত্যকা থেকে হীমশীতল হাওয়া। হযরত ইব্রাহীম সেই রোরুদ্যমানা রমনী এবং তার পুত্রকে সেই উপত্যকায় রেখে চলে গেলেন দিয়ে গেলেন একটি পানির মশক এবং খেজুর ভর্তি একটি চামড়া ব্যাগ। তিনি চলে গেলেন উত্তর দিকে মাদাঈদ হয়ে কেনান দেশে তাদেরকে একা ফেলে।
এমনি করে দিন যায় রাত আসে মশকে পানি নেই এক ফোঁটও। এক সময় সমস্ত শক্তিকে ছাপিয়ে উঠলো হতাশা। কোলের শিশু কাঁদতে থাকলো পানির জন্য।
বিবি হাজেরা শিশুর কষ্টে উদভ্রান্ত হয়ে দু’হাত তুলে দৌড়াতে থাকেন উপত্যকার ভিতর দিয়ে এদিক ওদিক যদি দূরে কোথাও দেখা যায় কোন কাফেলা। আবার গিয়ে ওঠেন মারওয়া। আর পিছনে ফিরে তাকান পিপাশায় ছটফট করা কলিজার টুকরো তাঁর ইসমাইল বেঁচে আছে কি না। উপত্যকার ঢালুতে এলে কলিজার টুকরা তাঁর চোখের আড়াল হয়ে যায়, তাই তিনি দৌড়ে পার হন। উহা ছিল বাস্তবিকই এক নিদারুণ করুণ দৃশ্য। বিবি হাজেরার সেই দৌড় আহাজারি, আল্লাহর কাছে খুব পছন্দ হয়। সেই স্মৃতিকে ওমর করে রাখার জন্য আল্লাহতায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত সকল হাজীর পর দুই পাহাড়ের মধ্যে ছুটাছুটি করা ওয়াজীব করে দিয়েছেন। ‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ মক্কা শরীফের দু’টি পাহাড়। বর্বর যুগে যেগুলোর পর দু’টি মূর্তি স্থাপিত ছিল। সাফার মূর্তিটির নাম ছিল ‘এছাক’ যা পুরুষ আকৃতির এবং ‘মারওয়া’ মূর্তিটির নাম ছিল ‘নায়লা’ যা নারী আকৃতির বিশিষ্ট ছিল। কাফেররা এই দুই পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করত এবং মূর্তিদ্বয়কে চুম্বন করত। এ সম্পর্কে আয়াত নাজিল হলো সাফা ও মারওয়া আল্লাহ নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম। অতএব যে কেউ কা’বা গৃহে হজ্ব কিংবা ওমরা করে এ দুটি পাহাড় তাওয়াফ করলে তাদের কোন পাপ নেই এবং যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকর্ম করে তাঁকে আল্লাহ পুরস্কার দেন। তিনি সর্বজ্ঞ।
সূরা আল বাকারা আয়াত: ১৫৮।
এখন আর সেই উপত্যকা নেই। সব সমান আর মসৃন আর সমতল। সাফা মারওয়া মর্মর পাথর দ্বারা মোজাইক করা তৃতীয় তলা বিশিষ্ট, সম্পূর্ণ সাফা-মারওয়া পাহাড় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে হরম শরীফের সাথে সাফা মারওয়া পাহাড় ডায়াজক্ট (সেতু পথ) তৈরি করে দুই পাহাড়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা হয়েছে।
এখানে এসে হাজী সাহেবদেরকে দৌড়াতে হবে মা হাজেরার মমতা ও ব্যাকুলতার পুণ্য স্মৃতি স্মরণ করে। আল্লাহর নবী দৌড়েছেন তাঁর নূরানী কাফেলার সকলে দৌড়েছেন। যুগে যুগে এই পুণ্য ভূমিতে যারা আসবেন সকলকেই দৌড়াতে হবে, শুধু অনুকরণের জন্য, শুধু সাদৃশ্য গ্রহণের জন্য।
আজ যেখানটায় মক্কা-মুকাররমা দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পিছনের কাহিনী হলো হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি হাজেরার গর্ভে হযরত ইসমাইলের জন্ম হয়েছিল বলে প্রথমা স্ত্রী বিবি ছায়েরার বিদ্বেষের কারণ হয়ে উঠেছিল। যার পর হযরত ইব্রাহীম মনে কষ্ট পেয়েছিলেন যখন তাঁর অনমনীয় স্ত্রীর মন পাবার জন্য দৈবলীলাক্রমে হেজ্জাজ প্রদেশের মরুভূমির এক পর্বত গুহায় বিবি হাজেরাকে শিশু পুত্রসহ বনবাস দিয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) মহান আল্লাহর এতো প্রিয়পাত্র ছিলেন যে, তিনি বিশ্বাস করতেন মহান আল্লাহর রহমতের কোনো সীমা নেই। মহান আল্লাহ তাকে শান্ত¦না দিয়েছিলেন এভাবে শিশু ও তোমার স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে তোমার যেনো কোন কষ্ট না হয়, এই পুত্র থেকে আমি উত্থান ঘটাবো এক জাতির। এক সময় সাফা ও মারওয়া সঙ্গী শেষ হলো। আমার মাঝে এ অনুপম তৃপ্তি অনুভূত হলো। সাফা-মারওয়া এক অন্যরকম রাত আমার আত্মার সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চকর স্বাদ যা আমাকে আজও উন্মাতাল ও উদভ্রান্ত করে তুলেছে।
লেখক: কলামিস্ট