মানুষ ও মৃত্তিকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৩৪:৫৫ অপরাহ্ন
হিফজুর রহমান
কিছুদিন থেকে মাটির কথা মনে হচ্ছে বারবার। ভাবি, এটা শুনলে মানুষ হাসবে। তবু এমনটা হচ্ছে। এরূপ হওয়ার সম্ভাব্য কারণ বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু উল্লেখ্যযোগ্য তেমন কিছুই পাই না। মাটি তো আমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধু নয়; কোনো পোষা প্রাণী বা নিজের লাগানো কোনো গাছও নয়, এমনকি কোনো শখের বস্তু বা স্মরণীয় প্রতীকী কিছুও নয়। তবুও এমন হচ্ছে। স্বজ্ঞানে এর কোনো হেতুর নাগাল পাচ্ছি না। তাহলে কি মৃত্তিকা এসবের উর্ধ্বে এমন কিছু, যা আমি চেতনভাবে জানি না! সাধারণভাবে ভাবলে তো দেখা যায় বিশ^ব্রহ্মান্ডের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্রের উদাপাদনসমূহ সম্পর্কে ভালোভাবে আমরা না জানলেও এ পৃথিবীর প্রাকৃতিক উপাদান সম্পর্কে মোটামোটি জানি। আমরা এটাও জানি যে, পৃথিবীর বড় একটি উপাদান হচ্ছে মাটি। এ মাটি সম্পর্কে বোঝা যায় যে, পৃথিবীতে যেসব উপাদানকে আমরা জড় পদার্থ বলে জানি তন্মধ্যে মাটি হচ্ছে সবচেয়ে নিরীহ বস্তু। অন্যান্য যেসব প্রাকৃতিক উপাদান না থাকলে আমাদের মুহূর্ত চলে না, যেমন- বায়ু, পানি তারা আমাদের উপকারের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিবিশেষও করতে পারে। বাতাস আমাদেরকে প্রাণ বায়ু দিয়ে, পানি আমাদের শরীর যন্ত্রকে চলমান রেখে বাঁিচয়ে রাখলেও কখনো কখনো ঝড়-তুফান, সাইক্লোন-টর্নেডো, বন্যা-প্লাবন আমাদের প্রাণ সংহার থেকে শুরু করে বাড়িঘর, ক্ষেত-খামার, গবাদি, বৃক্ষরাজি সবকিছু নিমিষে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু মাটি থেকে সেরূপ বড় কোনো আশংকা নেই। সে শুধু দিয়েই যায়, নিজের ধ্বংস সাধন হলেও কখনো উহ্-আহ্ পর্যন্ত করে না। কেটে নেন, পুড়িয়ে দেন কোনো বিরূপতা তার নেই।
মাটির কেবল এরূপ নির্জীবতাই রয়েছে। তাই বলে কি মাটি একেবারেই অপদার্থ বস্তু? তা তো মনে হয় না। দেখা যায়-মাটিই আমাদের জীবন। এ মাটি থেকেই আমাদের এবং অন্যান্য জীব ও প্রাণীর প্রথম চাহিত উপাদান খাদ্যের যোগান। খাদ্য ছাড়াও বস্ত্র, আবাস, উপজাত হিসেবে ঔষধ-পথ্য সবই আমাদের নাগালে আসে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ মাটি থেকেই। আমাদের বৈষয়িক অগ্রগতির যতসব উপকরণ ও জৌলুস তা সবই মাটিরই সন্তান। আমাদের ভূ-পৃষ্ঠের সর্বত্র একই প্রকৃতির নয়। উপরিভাগ প্রায়ই কর্দমময় অর্থাৎ পলিল। আমরা জানি এ পলিল নরম মাটির মধ্যে রয়েছে সিলিকন, ফসফরাস, অভ্র ইত্যাদি খনিজ পদার্থচুর্ণ এবং জৈব উপাদান যেথায় বৃষ্টি এবং পানির সহায়তায় সহজেই আমাদের খাবারের শস্য, তৃণলতা এবং ফলদ ও কাষ্ঠ জাতীয় বৃক্ষ জন্মায়। কিন্তু যেখানকার মৃত্তিকায় খাদ্য উপাদন জন্মায় না অর্থাৎ যে মাটিতে জৈব উপাদান এবং পানি কম বা নেই, তা কি অপাংতেয়। এ নিরস বালুকারাশির সংশ্লেষ থেকেই আমরা পাই সুরম্য কাচ, সিমারিক, মার্বেল ইত্যাদি। আর পাথর বা শিলা জাতীয় কঠিন মাটি তো সরাসরি ব্যবহার করছি এমন কাজে যাতে আমরা দেবে না যাই, থাকতে পারি স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে। আমাদের পাশের মেঘালয়ের পাহাড়ের দিকে থাকালেই বোঝায় যায় এ পাহাড় কেবল পাহাড় নয়; অফুরান সম্পদের স্তুপ। মাটির পৃষ্ঠভাগের নীচের স্তর সমূহের খবর আমরা কতটুকু জানি! এ পর্যন্ত যতটুকু জানি, তা হিসেব করলে বোঝা যায় ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ আমাদেরকে যা দিচ্ছে তার অভ্যন্তরভাগ দিচ্ছে তা থেকে অনেকগুণ বেশি। যে দু’টি বস্তু ছাড়া মানবজাতির অগ্রযাত্রা এবং সভ্যতা কদম ফেলতে পারতো না, তা হচ্ছে লৌহ এবং জ¦ালানি। আর এ উভয়ই আসছে মাটিরই গর্ভ থেকে। শুধু কি তাই? স্বর্ণ-রৌপ্য সবই আমরা নিচ্ছি ওখান থেকেই। এ পৃথিবীর চোখ ধাঁধানো ক্রমাগত উন্নয়ন অবকাঠামো, বিজ্ঞানের অকল্পনীয় পসার এবং আমাদের বৈষয়িক ভোগ এসবের সাথে রয়েছে মাটির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লেষ। মাটিবিহীন মানুষ টিকে থাকা এবং অগ্রসর হওয়া অচিন্তনীয়।
সর্ব প্রসবিণী এ মাটিকে কি আমরা এভাবে বুঝি? না, আমরা আসলে মাটিকে এভাবে বুঝি না, চিনিও না। মাটিকে আমরা চিনি দাঁড়াবার এবং নিজেকে আরো প্রসারিত করার পাটাতন হিসেবে। নিজের যেটুকু মাটি অর্থাৎ জমি বা ভূমি আছে তা থেকে আরো বহুগুণে আমরা বাড়াতে চাই। সেটা যে প্রক্রিয়ায়ই হোক। কখনো কিনে, কখনো জবরদখল করে, কখনো বা কাউকে তাড়িয়ে দিয়ে, আবার কখনো বা জালিয়াতি করে। এতে রয়েছে নিজের আয়-সম্পদ বৃদ্ধির প্রশস্ত দিগন্ত এবং সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি আয়ত্ব করার সোপান। এ কাজ আমরা করি গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সর্বত্র । কারণ, ভূ-সম্পত্তির মালিকানা দেয় আমাদেরকে একটা দৃশ্যমান শান্তি এবং ছোট-বড় রাজসিক আমেজ। সুবিধাজনক জমি থাকলে তো পোয়াবারো। অন্যান্য সম্পদ, বিলাস, খ্যাতি চলে আসে অনায়াসে। কাজেই মাটির অধিকার চাই বৃহৎ পরিসরে। মাটির এ মালিকানা বা দখল পেতে প্রাণ গেলেও কবুল। এতই প্রিয় এবং কাক্সিক্ষত বস্তু এ মাটি আমাদের কাছে । মাটিতে টাকার মার নেই। মাটি এতই খাঁিট মানব সমাজে। কিন্তু এ মাটির প্রতি আমাদের কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ কি আছে! যার কাছ থেকে আমরা কোনো উপকার পাই, স্বার্থ উদ্ধার করি তার প্রতি সাধারণ একটা শ্রদ্ধাবোধ পোষণ করি। মাটির ক্ষেত্রে আমাদের এসবের প্রয়োজন হয় না। উপরন্ত নীরব এ মাটির ভোগ আরো বৃদ্ধি করে চলি।
মাটির প্রতি মানুষের এ মোহ কি তার প্রতি কোনো ভালোবাসা থেকে? তেমন তো নয় মোটেই। এ মোহ হচ্ছে মাটি সারা জীবন দুগ্ধবতী থাকার কারণে। মাটি তার মালিককে দিয়ে চলে অন্ন-বস্ত্রের মতো সমৃদ্ধি এবং কুর্নিশের ব্যবস্থা। তাই মাটির দখল তার কাছে অতি লোভনীয়। এ মোহে চতুর-তস্কর জাতি-গোষ্ঠী বিশ^ প্রান্তর চষে বেড়িয়েছে; সম্ভাবনাময় দেশ-জনপদ করায়ত্ব করেছে। যত কাল পেরেছে নেটিভদের ভৃত্য বানিয়ে ওই মাটির নির্যাস তুলে েিনয়ছে। চেয়েছে আরো দেশ দখলে নিতে; সাম্রাজ্য বিস্তারে তারা হয়েছে নিরেট দস্যু। এরূপ লুণ্ঠন এবং দুহন আজো চলে পরোক্ষভাবে। তেমনি অমানিসার যাতনায় আমরাও পড়েছিলাম এবং সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষায় কঠিন হুংকার দিয়েছিলাম- “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী”। তেমনি যুদ্ধ আমরা ব্যক্তি পর্যায়েও করি ওই মাটি নিয়ে। এখন বাড়ির সীমানা নিয়ে প্রতিবেশীকে বলি-দেহে রক্ত থাকতে এক ইঞ্চিও ছাড়বো না। অপর পক্ষও তেমনি গর্জন দেয়। এছাড়া খুন-খারাবি, আইন আাদালত তো হয়ই। কিন্তু তা কি মাটির প্রতি কোনো ভালোবাসার কারণে? না, তা হয় মূলত: মাটির উপর নিজ অধিকার পাকাপোক্ত করার মানসে। আসলে মাটির প্রতি আমরা ভালোবাসার কোন কারণই উপলব্ধি করি না। আমরা কেবল মাটিকে ভোগ করতে চাই, দখলে রাখতে চাই। তা থেকে সুবিধা নিতে চাই, সমৃদ্ধি বের করতে চাই। যে কিছু সংখ্যক মানুষ মাটিকে জীবনের সঙ্গি করে নিয়েছে তাদেরকে তো চাষা বলেই ডাকি। চাষবাসের বাইরের যারা পাহাড় কাটা, অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলনে বাধা দেয়, তাদেরকে নাজেহাল করি। পথের কাঁটা অপসারণ করে অধিক মাটির মালিক হওয়া জন্য আমরা হয়ে পড়ছি মাতাল-উন্মাদ। ভূমির আপন না হয়ে উল্টো আমরা হয়ে যাচ্ছি ভূমির খাদক। মাটির প্রতি এই তো আমাদের আচরণ।
যে মাটির জন্য আমাদের এতো হানাহানি, সে মাটি আমরা চিরদিন কিন্তু ধরে রাখতে পারি না। কখনো লাভালাভের জন্য ছেড়ে দেই, কখনো দখল টিকাতে না পারলে সরে পড়ি, কখনো বা নেতিয়ে পড়লে বিক্রি করে মায়া ত্যাগ করি। আর মরে গেলে তো নিজেই মাটির সাথে একাকার হয়ে যাই। তবুও মাটির ব্যাপারে একটা লোভাতুর আগ্রহ আমরা আজীবন পোষণ করে চলি। যার জায়গা-জমি কম না নেই সে সারা জীবন নিজেকে অসহায় ভাবে, একটু জমির মালিক হওয়ার তাড়না নিয়ে ঘুরে। যার অঢেল জমি রয়েছে, নিষ্ফলা বিরাণ ভুমি হলেও একটুও কাউকে ছেড়ে দিতে পারে না। আমরা জমির হিস্যা থেকে বোনকে বঞ্চিত করি, সুযোগ পেলে ভাইকেও ঠকাই । সবই নিজের কব্জায় রাখতে চাই। যেনো মটির সাথে আমরা লেগেই থাকতে চাই।
যে কারণেই হোক মাটির প্রতি মানুষের যেমন একটা টান আছে, তেমনি মানুষের প্রতিও মাটির একটা নির্মোহ বন্ধুত্ব রয়েছে। সে বন্ধুত্বের ভালোবাসা থেকে মাটি যেনো মানুষের সাথে কথা বলতে চায়। সে তার ভেতরকার অফুরন্ত সম্পদ মানুষের হাতে তুলে দিতে উদগ্রীব। সে মানুষকে ডেকে বলে আমার এ পাশের পকেটে রয়েছে সোনা এবং সোনার চেয়েও দামি আকর; সব নিয়ে যাও। আরো বলে ও পাশের পকেটে আছে ইউরেনিয়াম, গ্যাস আরো কত কী; নিয়ে কাজে লাগাও। সে ডাকে আমরা হুমড়ি খেয়ে পাহাড়-পর্বত ভেদ করে নেমে পড়েছি গভীর সমুদ্রের তলদেশে। সেখানকার মাটি খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসছি তেল-গ্যাস এবং সযত্নে রক্ষিত মূল্যবান সব রত্ন। এভাবে মাটি অকাতরে আমাদেরকে সব কিছু দিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় যতদিন মাটি ও মানুষ থাকবে ততদিন মাটি মাুনষের প্রতি তার অকৃত্রিম বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত রাখবে।
বোঝা যায় মাটি ও মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও নিবিড়। মানুষ মাটির কাছে যায় তার নিজ প্রয়োজনে। কিন্তু মাটি! মানুষের কাছে কি তার কোনো প্রয়োজন বা নেয়ার কিছু আছে? বরং সে তো আসে আমাদের জন্য অপার সম্ভাবনার ডালি নিয়ে। তার সব কিছু উজাড় করে দিতে চায়। কেনো এতো উদার হওয়া? তাহলে কি মানুষের সাথে মাটির কোনো আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে! তা হয়তো আমরা জানি না, জানবো না; জানার চেষ্টাও করবো না। প্রারম্ভে বলেছিলাম- বার বার মাটির কথা মনে হচ্ছে; অথচ কারণ বুঝি না। আমার এ না বোঝার কারণে কি তাহলে মাটির সম্পর্কের ব্যাপারে দূর থেকে কোনো পবিত্র সত্তা আমার অবচেতন মনে বার বার সে অমীয় ভেদজ্ঞান শুধাচ্ছে- “মিনহা খালাক্বনা কুম, ওয়া ফীহা নু’ঈদুকুম, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তা রাতান উখরা”: এ মাটি থেকে আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এ মাটিতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেবো এবং এ মাটি থেকেই তোমাদেরকে পুনরোত্থিত করবো!
লেখক : প্রাবন্ধিক।