প্রকৃতির স্নেহে বেড়ে ওঠা সিলেট
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ৯:২৬:৩৯ অপরাহ্ন
শেখর ভট্টাচার্য
মানুষ যখন একা থাকে, তখন সবচেয়ে কম একা থাকে। অবচেতন মন থেকে স্মৃতিরা চেতন মনে উঠে এসে সঙ্গী হয় মানুষের। চাইলেই তাই একা থাকতে পারেনা মানুষ। ইদানীং চোখ বন্ধ করলে অথবা কোথাও ভ্রমণ গেলে ষাট সত্তর দশকের সিলেট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিতান্ত একটি মফস্বল শহর কী করে চোখের সামনে নগরে পরিণত হলো, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমরা যারা ষাটের দশকে কিংবা তারও পূর্বে জন্ম নিয়েছি। ইদানীং মনে হচ্ছে, আমাদের দেখা ষাট, সত্তর দশকের সিলেট শহরের কিছু এলাকার প্রাকৃতিক অবস্থার বর্ণনা লিখে না রাখলে, পরবর্তী প্রজন্মের নাগরিকদের কাছে সিলেটের আদি প্রাকৃতিক রূপ চিরতরে হারিয়ে যাবে। একারণে বর্তমান সিলেট নগরীর সে-সময়ের কিছু অংশের প্রাকৃতিক রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সিলেট শহরের কাজলশাহ। কাজলশাহ’র অন্য নাম কাজল হাওর। কাজল হাওর কেনো? এই জনপদের পশ্চিম পাশেই ছিলো হাওরের মতো বিস্তীর্ন ফসলের মাঠ। কাজলশাহ ষাট, সত্তর দশকে সিলেট শহররের পশ্চিম প্রান্তের একটি জনপদ। শহরের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে এখন আর কাজলশাহ প্রান্তে নেই। কাজলশাহের মতো ছোট ছোট জনপদকে আমাদের মফস্বলীয় ভাষায় বলা হতো বা হয় ‘পাড়া’। আমার নিজের জন্মও এই পাড়াতে।ষাট, সত্তর দশকে কাজলশাহ শহরের ভেতরে থেকেও ছিলো অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পর্যন্ত কাজলশাহতে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। বৃক্ষ শোভিত এক অনিন্দ্য সুন্দর জনপদ। সন্ধ্যার পর কুপি বাতি বা ল্যাম (ইংরেজি ভাষার ল্যাম্প থেকে সিলেটি ভাষায় লেম/ল্যাম), হারিকেন জ্বলে উঠতো ঘরে ঘরে। জোনাকিরা আলো জেলে বসত-ঘরে ঢুকে যেতো ভুল করে। জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে, শীতলপাটি বিছিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কতো কথা। বড়রা ছোটদেরকে শেখাতেন, এই হলো সপ্তর্ষি। এই দেখো সাতটি তারা, কী সুন্দর ভাবে আকাশের গায়ে শুয়ে শুয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কাজলশাহ’র সব চেয়ে বড় বাড়ি ছিলো, কবিরাজ বাড়ি। রেল বা বাস স্টেশনে নেমে রিক্সা চালককে কাজলশাহ না বলে শুধু কবিরাজ বাড়ি বললেই কাজলশাহ নিয়ে আসতো। কবিরাজ বাড়ির সামনেই একটি বিশাল দীঘি। দীঘির চারপাশ তখনো বাঁধানো ছিলোনা। দীঘির পার ঘেষে ছিলো, ‘অফিস টাইম ফুল’ সকাল দশটায় ফুলটি তার পাপড়ি মেলে ধরতো আর বিকেল পাচটায় পাপড়ি গুলো নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতো। এযেনো সত্যিকারের অফিসের সময় মেনে চলা। উজ্জ্বল গোলাপী রঙের ছোট ছোট ফুল। এই দীঘির শান বাধানো ঘাটে, সারা দিন প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় গালগল্প লেগেই থাকতো।দীঘির পার ঘেসে শ্যাওলা, ছোট, ছোট মাছের খেলা লেগে থাকতো। দীঘির পারে ছোট ছোট অসংখ্য বুনো ফুলের গাছ। কবিরাজ বাড়িকে ঘিরে সারা বছর জুড়ে নানা উৎসব লেগেই থাকতো। পশ্চিম দিকে কবিরাজ বাড়ির সীমান্ত যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরেই বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সেই মাঠে সারা বছর নানা ধরনের নানা বর্ণের ফসল। হেমন্তে সোনালী ধানে যখন মাঠ ভরে যেতো, সে এক অপূর্ব, অতীন্দ্রিয় রূপ। সেই ফসলের মাঠ পেরোলেই কাশবন। শরতে সাদা কাশ, নীল আকাশের নীচে যখন বাতাসে দোল খেতো, মনে হতো শুভ্র রঙের একটি ছোট সমুদ্দুর। ফসলের মাঠের এক দিকে নরসিংটিলা। সেখানে মুনিপুরি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। সারা বছর অপেক্ষা ছিলো মানুষের, রথের মেলার জন্য। নরসিংহটিলা থেকে রূপকথা কিংবা পুরাণের গল্পের বর্ণনার মতো নানারকম ফুল, পাতায় সাজিয়ে, উঁচু একটি রথ বের হয়ে রিকাবীবাজার যেতো। রিকাবীবাজারে শহরের সব কোন থেকে আসা রথ গুলোর মূল গন্তব্য। নরসিংহ টিলার রথের সাথে সাথে কাজলশাহের শিশু কিশোররা ছুটতো রিকাবী বাজারের দিকে। এই কথা গুলো যখন লিখছি, কতো কতো কথা এক সাথে ভীড় করছে মনের কোনে। কাজলশাহর ফসলের মাঠের উত্তর দিকে তরতর করে বয়ে চলা ছড়া। ছড়ার জল এতোই স্বচ্ছ্ব যে উপর থেকে তাকিয়ে ছড়ার তলদেশের বালি, পাথর চোখের সামনে খেলা করতো। সেই ছড়ার এক পাশে সাগরদীঘি। দীঘির নামেই বুঝা যায় এর বিশালতা। সত্যিই সাগরদীঘি একটি বিশাল জলাধার। সাগর দীঘির বিশালতা এবং এর চারপাশে জন্ম নেয়া অসংখ্য গাছ গাছালির সৌন্দর্যে এলাকাটির সৌন্দর্য ছিলো বর্ণনাতীত।
লেখাটি যখন স্মৃতি থেকে লিখে যাচ্ছি তখন মনে হচ্ছে স্বাধীনতার পর যাদের জন্ম তারা কী বিশ্বাস করবে কাজলশাহ অঞ্চলের এরকম প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা। বিশ্বাস না করার অনেক কারণ রয়েছে। ওই যে ফসলের মাঠের কথা বললাম, সেই ফসলের মাঠের বুক চিরে এখন দাঁড়িয়ে আছে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল। স্বাধীনতার পূর্বেই এই মেডিকেল কলেজটির নির্মান কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। ফসলের মাঠের আর অস্তিত্ব নেই। কাশবনে আকাশ ছোঁয়া দালান। নরসিংহ টিলার মণিপুরি সম্প্রদায়ের সংখ্যা এখন হাতে গোনা। ভূমিখেকোরা ছড়া দখল করে এর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন করে ফেলেছে। বিজলী বাতির আলোর রোশনাই থেকে বেচে থাকার জন্য জোনাকীরা কাজলশাহ থেকে নির্বাসিত। কাজলশাহ এখন রুক্ষ, খট খটে অপরিকল্পিত ইটের বাগান।
আজ যেখানে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ তার ঠিক অপর দিকে ছিলো এক চমৎকার পাড়া। পাড়াটির নাম ছিলো মালাকার পাড়া। সে পাড়াটিও ছিলো এক দর্শনীয় স্থান। আমার পরিস্কার মনে আছে, মালাকার পাড়ার বাড়ি গুলো ছিলো সাজানো, গোছানো মাটির বাড়ি। নিকোনো উঠান , নিকোনো মেঝে। উঠানের পাশে ছিলো চোখ জুড়ানো ফুলের বাগান। প্রতিটি বাড়ি যেনো শিল্পির আঁকা ছবি। ফুল বাগাণের সামনেই পুকুর। টলটলে জলের পুকুর। তখনও টিউবওয়েল স্থাপন হয়নি বাড়ি গুলোতে। গেরস্থালী কর্ম কাণ্ড, খাবার জল সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জলের উৎস ছিলো পুকুর। আমি যখন স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই এখনও আমি দেখতে পাই নিকোনো আঙিনার পাশে, নাম জানা, অজানা ফুলের বাগাণের সুষমা মন্ডিত সেই বাড়িগুলো। আমি জানিনা আমাদের সন্তানেরা জানে কী না এরকম একটি সুন্দর জনপদ ছিলো ওসমানী মেডিকেলের খুব কাছেই।
কাজলশাহের পাশেই সাগরদীঘির কথা বলেছি। সাগরদীঘির উত্তর পাশেই সুবিদবাজার। আজ যেখানে সুবিদবাজার তার পূর্ব পশ্চিমে, ধানী ক্ষেত ছাড়া আর কিছু ছিলো বলে মনে হয়না। বাড়ি ঘর ছিলো খুব সীমিত। সুবিদবাজারের উত্তর পাশে ছিলো বিখ্যাত দস্তিদার বাড়ি। দস্তিদারবাড়ির পূর্ব পুরুষ সুবিদনারায়ণের নামেই স্থাপিত হয় সুবিদবাজার। সুবিদবাজারের যে অল্প সংখ্যক বাড়ি-ঘর ছিলো, সে সমস্ত বাড়ি ঘরে বিদ্যুৎ বাতি ছিলোনা। বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে ছিলো বন। রাস্তার দু’পাশে ছিলো পত্র পল্লবে সুশোভিত। কৃষ্ণচূড়া, শিরিষ, পলাশ ফুলের গাছ ছিলো অসংখ্য। বসন্তে সুবিদ বাজার অঞ্চলে গাছে গাছে বিচিত্র রঙের ফুল। ফাল্গুন মাসে প্রকৃতির অপরূপ রূপের বাহারের কথা মনে হলে এখনও স্মৃতি কাতরতায় পেয়ে বসে। সুবিদবাজারের পথের পাশ ঘেসে ছিলো, কল কল করে বয়ে চলা ছড়া। আজ যে রাস্তা চলে গেছে সুনামগঞ্জের দিকে, সেটি ছিলো, মাটির রাস্তা। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে অর্থাৎ ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে এই রাস্তায় বড় বড় বোল্ডার বসানো হয়েছিলো। সুবিদবাজারের দস্তিদার বাড়ির সামনে বিরাট দীঘি। এ’দীঘিটিও স্বচ্ছ্ব জলে ভরপুর ছিলো। দীঘির মধ্যিখানে নানা রঙের শাপলা ও জলপদ্ম ফুটে থাকতো। এযেনো রূপকথার অপরূপ এক জলাধার। দস্তিদার বাড়ি ঢোকার মুখে হাতের বাম দিকে ধান ক্ষেতে পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে গড়ে ওঠে বৃহত্তর সিলেটের প্রথম প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইন্সটিউট। এই অঞ্চলের প্রথম সরকারী দালান কোঠা।
কাজলশাহ, সুবিদবাজার এভাবেই প্রকৃতি শোভিত গ্রামীন জনপদ থেকে ধীরে ধীরে প্রাসাদোম অট্টালিকার নগরের অংশ হয়ে পড়ে। মানুষের প্রয়োজনেই নানারকম অবকাঠামো, পথ-ঘাট, শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। সমস্ত বিশ্বজুড়েই এরকম নগরায়ণ হয়েছে। তবে উন্নত বিশ্বে নগরায়ণের সময় সবার আগে বিবেচনায় নিয়ে আসা হয় প্রকৃতিকে। সমস্ত উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গাছ, গাছালি, পুকুর, নদী, এমন কী কীট পতঙ্গেরও যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে দিকটি বিবেচনা করা হয়। আমরা নগর গড়ে নিজেদেরকে নিঃস্ব করে ফেলেছি। প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করে ফেলেছি। কাজলশাহ, সুবিদবাজারকে হয়তো আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবোনা তবে নগরের ভবিষ্যত সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নে আমারা যেনো আমাদের প্রকৃতিকে নৃশংসভাবে হত্যা না করি। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমরা আমাদের নগরের অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে পারি।
লেখক : প্রাবন্ধিক।