শীতার্ত মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ২:৪৯:৫৩ অপরাহ্ন
রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রতি বছর শীতকাল আমাদের মাঝে আসে। আবার চলেও যায়। কিন্তু কষ্ট হয় অসহায় ও দুঃখী মানুষের। বর্ষা ও শীতকাল। এ দুটো কালেই অসহায় মানুষরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভোগে। যৎসামান্য সাহায্য তারা পায় তা দিয়ে কোনোভাবেই তাদের কুলোয় না। কষ্ট সহ্য করেই দিন পার করতে হয়। হাড় কাঁপানো শীতের হাত থেকে বাঁচাতে অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য আপনিও কিছু করুন। আপনার পুরোনো জামা-কাপড় যেগুলো হয়তো আপনার কোনো কাজেই লাগছে না। সেসব জামা-কাপড়ই এখন হয়তো একজন রাস্তার মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। তাদের প্রতি একটু সদয় হোন! ঋতু পরিক্রমায় বাংলা পৌষ ও মাঘ শীতকাল। ষড়ঋতুর এই দেশে এখন আর ষড়ঋতু নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীত, গরম ও বর্ষা এ তিন ঋতুরই প্রভাব। প্রচন্ড গরম, অতিমাত্রায় শীত ও অতিবৃষ্টির প্রভাব বেশি। ষড়ঋতুতে বাংলা পৌষ ও মাঘ শীতকাল হলেও কোনো কোনো বছর কার্তিকের শেষদিক থেকে শীত শুরু হয় এবং তা থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং এর মাত্রা নিচে নেমে আসে। তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ শীত অনেক সময় হাড় কাঁপানো শীতে পরিণত হয়। এ বছর শীত অনেক পরে এসেছে। পৌষ মাসের শেষদিকে তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। সারা দেশে এখন হাড় কাঁপানো শীত। এই শীতে শিশু ও বৃদ্ধরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা তিন-চার গুণ বেশি। এখন পুরোদমে চলছে শীতকাল। নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে শুরু করেছে। গরম কাপড়ের অভাবে অসহায় মানুষগুলো রাতে ঘুমাতে পারে না। সমাজের উঁচুস্তরের মানুষজন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একটু মমতার দৃষ্টি দিলে তারা আরামে ঘুমাতে পারে। শীতার্ত মানুষগুলো কতটা দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। তা শহর-নগরের ফুটপাত, রেলস্টেশনে না গেলে বুঝা মুশকিল।
মানবতার সেবা সবচেয়ে বড় এবাদত। তাই আসুন, শীতার্ত মানুষগুলোর দুর্বিষহ জীবনের কথা ভেবে তাদের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেই। তাদের জন্য গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করি। আমাদের একটু সহায়তা লাঘব করতে পারে তাদের কষ্ট এবং দুর্বিষহ জীবন। আমাদের দেশে পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল। হাড় কাপাঁনো শীতে নাকাল দেশের দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ। প্রতিবছর এ সময়ে আসে শীত-শৈত্য প্রবাহ। দিনের বেলায় সূর্যের মুখ প্রায়ই দেখা যায় না। হিম বায়ু ভারী কুয়াশার সঙ্গে কমে যাচ্ছে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধানও। কুয়াশার চাদরে শস্যহীন মাঠ আর পাতাঝরা গাছের মলিনতা থাকলেও, ঘরভরা সোনালি ফসল অনেকের মনেই এনে দেয় পূর্ণতার অনাবিল আনন্দ। ক্ষণিককালের এই শীত মানুষের মনে পরশ বুলিয়ে দেয়, রেখে যায় কোমল কঠিন স্পর্শ। পৌষের এই দিনগুলোতে উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে শীতবুড়ির হিম শীতল নিঃশ্বাস। ধরণী হঠাৎ হয়ে পড়ে জড়সড়। বিবর্ণ হলুদ পাতারা চুপিসারে খসে পড়ে পথের ধুলোয়। শীতের দীর্ঘ রাতের কুয়াশার আবরণ গায়ে মেখে সুবহে সাদিকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। তখন গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে মানুষের। ঠা-া পানিতে অজু করে নামাজে দাঁড়ায় বড়রা। ছোটরা লেপের নিচে দাদা-দাদির গা-ঘেঁষে গল্প করে, ছড়া কাটে মিষ্টি সুরে। শীতের দিনে এ স্মৃতিগুলো সত্যিই অসাধারণ! শীত যেমন বাহারি আনন্দ বয়ে আনে, ঠিক তেমনি অনেকের জন্য বয়ে আনে অনাবিল কষ্টও। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, চর, হাওরাঞ্চলসহ শহরের ছিন্নমূল সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ক্ষণস্থায়ী এই শীত আসে অভিশাপ হয়ে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। এই শীতে দরিদ্র কৃষিজীবীরা প্রচ- শীতে জবুথবু হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যেই মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। নগরবাসীর কাছে অবশ্য এই শীত এখনো তেমন তীব্রতায় অনুভূত হচ্ছে না।
তবে গ্রামে অনুভূত হচ্ছে প্রচ- শীত। কুয়াশা ও ঠা-া বাতাস বাড়িয়ে দিয়েছে শীতের তীব্রতা। দেশের সব কটি জেলাতেই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস পেয়েছে, যা তীব্র শীতের অন্যতম কারণ! এই শীতের প্রকোপে দুস্থ, ছিন্নমূল, সুবিধাবঞ্চিত, ও হতদরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষদের দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটে, জনজীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। শীতবস্ত্রের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় তাদের। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতবস্ত্রের অভাবে বিপাকে পড়তে হয়। এই শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজন হয় উষ্ণতার পোশাক। কিন্তু, গরিবের ভাগ্যে জোটে না সেই পোশাক। অথচ বিত্তবানদের গেল বছরের শীতের পোশাক থাকা সত্ত্বেও এই বছর হাজার খানেক টাকা দিয়ে শীতবস্ত্র কেনা হয়ে গেছে। সমাজের অসহায় খেটে খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি আমাদের কোনো খেয়াল নেই বললেই চলে। অথচ তারা তাকিয়ে থাকে ধনীদের সহায়তার দিকে, মানবতার দিকে। কিন্তু, শীত ঋতুর সব ভালো দিকটাই যেন বিত্তশালীদের জন্য। শীতে বাহারি বিলাসী পরিধেয় ফ্যাশন হয় নজরকাড়া। পক্ষান্তরে শীতবস্ত্রহীন মানুষের দুর্দশার বাস্তবতাও প্রত্যক্ষ করতে হয়। হতদরিদ্রদের ভাগ্যে শীতের কামড় ছাড়া যেন আর কিছুই জোটে না! শীতের প্রস্তুতি দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর থাকে না বললেই চলে। দরিদ্র এবং অতি দরিদ্র পরিবারে শীতার্ত মানুষের দুঃখবহ দিনযাপনের করুণ-কঠোর চিত্র খুব অল্পই জাতীয় পর্যায়ের সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উঠে আসে। আর এলেও তা বেশিরভাগ মানুষের বিবেককে নাড়া দেয় না। যাদের পেটে ক্ষুধার তাড়না, তাদের শীতের পোশাক জোগাড় করা তো অলীক স্বপ্ন! ফলে নিদারুণ কষ্ট ও দুঃসহ অবস্থায় পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে দেশের লাখ লাখ দুস্থ, নিঃস্ব, ছিন্নমূল, গরিব, দুঃখী, বস্ত্রহীন শিশু, নারী-পুরুষ। পাচ্ছে না ঠিকমতো শীত নিবারণের পোশাক। হাড়কাঁপানো শীতে তারা আক্রান্ত হচ্ছে সর্দি-কাশি-হাঁচি-জ্বর, শীতকালীন ডায়রিয়ায়। এই আক্রান্তে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
ইতোমধ্যেই শীতজনিত রোগে মানুষকে সতর্কতা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালগুলোতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও; এর চেয়েও বেশি আক্রান্ত রোগীরা টাকার অভাবে আজ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। দুস্থ মানুষের পক্ষে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং চিকিৎসা গ্রহণ এক অসম্ভব ব্যাপার।
বাংলা প্রবাদে আছে, কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সুচিকিৎসা, ওষুধপথ্য এবং শীত মোকাবিলায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ। শীত এলেই শীতের নানা সবজিতে ভরে যায় বাজার। দাম হয় অপেক্ষাকৃত কম। অপেক্ষাকৃত কম দাম হলেও দুস্থ মানুষের পক্ষে শীতে উষ্ণতার কাপড় কেনা খুবই কষ্টসাধ্য। কেননা, যে কোনো দুর্যোগ-দৈবপাকে দুস্থ ও ছিন্নমূল মানুষই বিপাকে পড়ে বেশি। শীত এলে তো তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় দুস্থ মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। খড়কুটোর আগুন জে¦লে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায় অনেকে। কেউ আবার জেগে উঠে ছেঁড়া কাগজ জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। বস্তি, ফুটপাত আর রেললাইনে সামান্য কাপড় জড়িয়ে কোনোরকম শীত নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা! কাউকে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হয়। প্রচ- শীতে কাঁপছে তারা থরথর করে। নেই শীত নিবারণের উপযুক্ত আবাসন। চোখের পানি আটকে রাখা খুবই কষ্টকর। প্রকৃতির আচরণ তাদের অসহায়ত্বকে আরও প্রকট করে তোলে। শুষ্ক রিক্ততা আর দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে তাদের কাছে ধরা দেয় শীত। একদিকে শীতবস্ত্র ও লেপ-কম্বল কিনে শীত নিবারণ করা যেমন দুরূহ, অন্যদিকে পুষ্টিহীনতার কারণে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও তাদের কম। ফলে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে তারাই আক্রান্ত হয় বেশি। এসব মানুষের শীতের দুর্ভোগ কমাতে ধনীদের সহায়তার হাত বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।
প্রতিবছর বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ প্রচন্ড শীতের সময় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়। এদের যেখানে এক বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই তারা কিভাবে শীত বস্ত্রের ব্যবস্থা করবে। তাছাড়া শীতকাল শুরু হলেই গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের শীতজনিত রোগ বেড়ে যায়। এ সমস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা অনেক বড় ইবাদত। সমাজের বিত্তবান মানুষের সম্পদে অসহায় গরিবদের হক রয়েছে। একটি শীতবস্ত্র একজন হতদরিদ্র মানুষ কে কিনে দেওয়ার সামর্থ্য অনেক মানুষেরই আছে, প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা। প্রত্যেক মানুষ যদি একজনকে একটি করে শীতবস্ত্র কিনে দেন তাহলে হতদরিদ্র মানুষ শীতে কষ্ট পাবে না।
লেখক : কলামিস্ট।