নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ২:৫২:১৫ অপরাহ্ন
মো. আব্দুল ওদুদ
একতলা ভবন, বহুতল ভবন, প্রাসাদ, কিংবা অট্টালিকা, যাই বলি, সবই নির্মাণ শ্রমিকদেরই পরিশ্রমের ফল। নির্মাণ শ্রমিকেরা এসব কাজ না করলে হয়তো পৃথিবীতে এতো সুন্দর অট্টালিকা, প্রাচীনকালের তৈরি প্রাসাদ বা রাজমহল হয়তো কখনই দেখা যেত না। কিন্তু এই শ্রমিকদের যে নিরাপত্তা থাকা দরকার, সেটি ভেবেছি কি কখনো?
বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সারা দেশের নির্মাণ শ্রমিকেরা। অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে এদের অবস্থা খুবই নাজুক। তাদের যথার্থ নিরাপত্তা হয় না। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন বড় বড় ইমারত তৈরি করে যাচ্ছেন তারা। আর সেসব ইমারতে অতি স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরাপদে জীবনযাপন করে যাচ্ছেন ইমারত মালিকেরা। তার বিনিময়ে নির্মাণ শ্রমিকেরা শুধু সামান্য পারিশ্রমিক পান, কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি তাদের সংসার জীবন এ সামান্য অর্থ দিয়ে চলে কিনা?
নির্মাণ শ্রমিকদের আরো করুণ অবস্থায় পড়তে হয় যখন তাদের কোনো কাজের নিশ্চয়তা থাকে না। তাদের কাজ যদি না থাকে তাহলে তারা অন্য কোনো কাজও করতে পারে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোর হলেই নির্মাণ শ্রমিকেরা জটলা হয়ে বসে থাকেন। কেউ না কেউ এসে কাজে নিয়ে যাবেন- এমন আশাতেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন নির্মাণ শ্রমিকেরা। এসময় যে স্থানে তারা জটলা হয়ে বসে থাকেন সে স্থান দেখতে যেন মনে হয় কোনো হাট বসেছে। আসলে এ হাট বা বাজারে শ্রম বিক্রি করা হয়। তাই অনেকেই এটিকে শ্রমের হাট কিংবা মানুষ বেচাকেনার হাট বলে থাকেন। কারণ, এ হাটে সারা দিনের জন্য একজন শ্রমিককে অতীতে ২০০ টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয়। মানে কাজ করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কাজের মজুরি বাবদ দিন শেষে হাতে তুলে দেয়া হয় এই পরিমাণ টাকা। বর্তমানে নির্মাণ শ্রমিকদের পারিশ্রমিক এক দিনে দেওয়া হয় ৫০০-৬০০ টাকা। সভ্যজগতে অনেক ধরনের বাজার আছে। তাই বলে শ্রমের বাজার আছে এমনটি কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের এদেশে নির্মাণ শ্রমিকদের অবস্থা এতটাই করুণ যে, নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবেন না। যেখানে প্রত্যেক দিন সকালে শ্রমিক বেচা কেনা হয়ে থাকে। এমনি কয়েকটি হাট রয়েছে সিলেটের বন্দরস্থ জেল রোড, আম্বরখানা, মদিনা মার্কেট, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, মেজরটিলা, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সংলগ্ন রোড, টুকেরবাজার, তেমুখী নতুন ব্রীজ পয়েন্ট, সুবিদবাজার, তেররতন, শিববাড়ী সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব হাট বা বাজারে কাজের আশায় নির্মাণ শ্রমিক সহ নানা শ্রমজীবী মানুষকে সকাল থেকে বসে থাকতে হয়। পরে কেউ শ্রমিক নিতে এলে তার সাথে বনিবনা হলে কাজে যোগ দেন তারা।
নির্মাণ শ্রমিকেরা যাতে নিয়মিত কাজ এবং নিরাপত্তা পান সে জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। এছাড়া তারা নিজেরা যাতে কাজ পান সে জন্য নিজেদের দলগতভাবে থাকতে হবে। যারা নির্মাণ কাজে শ্রমিকদের কাজ করাতে নিয়ে আসবেন তারা সে দলের সাথে যোগাযোগ করে নিতে পারবেন। সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যাতে নির্মাণ শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা ভোগ করতে পারেন। তাছাড়া নির্মাণ শ্রমিকদের নিয়ে দেশের সচেতন মহলকেও ভাবতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা নিয়ে যারা সংগ্রাম করেন তাদেরও নির্মাণ শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। তাদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
শ্রমিকদের দিয়ে যারা কাজ করান, তাদেরও নির্মাণ শ্রমিকদের প্রতি মানবিক দৃষ্টি রাখতে হবে। এরা যে সব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন সে সব কাজের আগে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো অনেক নির্মাণ শ্রমিককে নিরাপত্তার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়। পাশাপাশি নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে গিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদেরকে পঙ্গুত্ববরণ করে পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে হবে। তাই সর্বাবস্থায় অবহেলিত নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তার সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কলামিস্ট।