সড়কে মৃত্যুর মিছিল কবে থামবে?
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৫৭:৪৮ অপরাহ্ন

পাপড়ি রানী রায়
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ও অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে। গণমাধ্যম আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এতো আলোচনা-সমালোচনার পর সড়কে বিশৃঙ্খলা এবং দৃর্ঘটনার হার কমে আসার কথা ছিল। কিন্তু আদতে বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। বলতে গেলে সরকারের আশ^াসে সড়কে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা কমার যে প্রত্যাশা জনমনে জেগেছিল তা ইতিমধ্যে চুপসে গেছে। মূল কথা হলো, সড়ক ও গণপরিবহণে শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তায় গৃহীত সরকারি উদ্যেগগুলো তেমন কোনো কাজে আসছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনা বেড়েই চলেছে। সড়কে একেকটি প্রাণহানি শুধু পরিসংখ্যান হিসাবে যোগ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলে। সড়ক কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার কারো এ নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। ২০১৮ সালে ছাত্রদের সড়ক আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে সরকার তাদের কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করেছিল। পরে এর বাস্তবায়ন আর দেখা যায়নি।
২০২২ সালে সড়কে ছাত্রদের প্রাণহানি আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্য দিকে সড়কে যত বিশৃঙ্খলা ছিল সেগুলোও আগের মতো রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে বেড়েছেও। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত বছরের সড়ক দুর্ঘটনার বিভিন্ন দিক নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে। সংগঠনটির হিসাবে, ২০২২ সালে দেশে ছয় হাজার ৮২৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৭১৩ জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬১৫ জন। নিহতদের মধ্যে এক হাজার ৬১ নারী ও এক হাজার ১৪৩ জন শিশু রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় তাৎক্ষণিক যে তালিকা পাওয়া যায়, পরে সেটি কতটা দায়িত্বের সাথে ফলোআপ করা হয় তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে- ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবর থেকে সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে। বাস্তবে দুর্ঘটনায় আহতদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত মিডিয়া পেশাদারিত্বের সাথে কতটা করতে পারে বা আদৌ আন্তরিকতা নিয়ে করে কি না প্রশ্ন রয়েছে। পরে নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ভুক্তভোগীদের দুর্গতি ব্যক্তি এবং পরিবারে গভীর নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনে। সে হিসাবও আমাদের কাছে থাকা উচিত। সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছরে রাজধানীতে ২২৭ জন নিহত হন। ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার আলাদা একটি ধরন দেখা যাচ্ছে। আগের বছরের তুলনায় এখানে সড়ক দুর্ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ- ৯৭ দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়েছে। প্রাণহানি বেড়েছে ৭৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে গাড়িচাপায় বা গাড়ির ধাক্কায়। রাতে ও ভোরের সময়। রাজধানীতে বেশি দুর্ঘটনার জন্য রোড সেফটি ফাউন্ডেশন কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে- মানুষের অসহিষ্ণুতা, যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, মোবাইল ফোনে চোখ রেখে চলাচল ও যানবাহনের আধিক্য। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ৬০ শতাংশের বেশি পথচারী। এ জন্য মালবাহী ভারী যানের বেপরোয়া গাড়ি চালনা ও বাইপাস সড়ক না থাকাকে দায়ী করা হচ্ছে। সড়কে দুর্ঘটনা সংঘটনের ক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বেশি এগিয়ে। তবে দুর্ঘটনাকেন্দ্রিক প্রচারও ঢাকাকেন্দ্রিক। অন্য দিকে দেশের সব অঞ্চলে সে তুলনায় কোনো সতর্কতামূলক প্রচার নেই।
সারা দেশে সমানতালে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় তুলনামূলক শিক্ষার্থীরা বেশি প্রাণ হারাচ্ছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে- প্রতিদিন তিনজন করে শিক্ষার্থীর সড়কে প্রাণ যাচ্ছে। গত বছর সড়কে প্রাণ হারানোদের মধ্যে ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ বছর এক হাজার ২৩৭ শিক্ষার্থীর রাস্তায় দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে। রাজধানীতে উপর্যুপরি ছাত্রদের সড়কে প্রাণহানির পর ২০১৮ সালে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারা। তবে ছাত্রদের প্রাণহানির সেই ধারা এখনো বর্ধমানহারে ঘটছে। সড়কে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার আরেকটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। গত বছর সড়কে প্রাণহানির ৪০ শতাংশ ঘটেছে মোটরসাইকেল আরোহীদের। এরা বয়সে বেশির ভাগ তরুণ। গত বছর নৌ ও রেলপথেও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৯৭টি নৌদুর্ঘটনায় ৩১৯ ও ৩৫৪টি রেল দুর্ঘটনায় ৩২৬ জন প্রাণ হারান। সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা না কমার পেছনে সরকারের নীতি প্রধানত দায়ী। সরকার বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতি নতজানু। ফলে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নে উৎসাহী নয়। এমনকি বিদ্যমান আইনের প্রয়োগেও শিথিলতা দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক বাংলাদেশের ভাগ্য হয়ে ভবিষ্যতেও থাকবে। এর ব্যতিক্রম হতে হলে সরকারকে গোষ্ঠীস্বার্থ পরিহার করে নীতি প্রণয়ন ও তা যথাযথ বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে।
লেখক : শিক্ষক।