স্যারদের সম্মান রক্ষা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৫৮:৪৬ অপরাহ্ন

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
চব্বিশে ডিসেম্বর ২০২২ তারিখের দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার একটি কপি হাতে নিয়ে অনেকটা রসিকতার উদ্দেশ্যে সেটি গিন্নীর হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলাম- ক্যামন লাগছে খবরটি? গিন্নী বেশ মনোযোগ সহকারে পড়তে পড়তে ভাবগম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, বিষয়টি মোটেই হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। এখানে অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট, অনেক বেদনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এ কান্নার স্বর সমাজের খুব কম মানুষের কানেই ঢুকছে। বিশেষ করে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তো বটেই। তাই বিয়ের জন্য পাত্রী চেয়ে যুবকদের মিছিলটিকে সামাজিক অনাচার-অবিচার আর মানবিক নির্মমতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। একে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।
গিন্নীর কথায় একটু থমকে দাঁড়াতেই হলো। পত্রিকার বিশেষ গুরুত্বপ্রাপ্ত রঙ্গিন খবরটির দিকে নজর দিতে গিয়ে দেখলাম কী নৃশংস ঘটনাই না ঘটে চলছে দুনিয়ায়। ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে ‘ব্রাইডগ্রুম মোর্চা’ নামে একটি সংগঠন এই অভিনব মিছিলটি বের করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। তাদের দাবী মহারাষ্ট্রে বিবাহযোগ্য মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ে ও ছেলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে প্রতি ১০০০ জন পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা ৮৮৯ জন। ফলে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং ব্যাপকভাবেই তা হয়ে চলছে। তারা দাবী করছে, সন্তান জন্মের আগে গর্ভস্থ ভ্রুণের প্রকার জেনে নেওয়ার দরুন এমন বৈসম্য তৈরি হয়েছে। এর কারণ হলো ঐ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নাকি এখনও অন্যায়ভাবে, অমানবিকভাবে কন্যা ভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে। সে রাজ্যে সরকার নাকি কিছুতেই তা বন্ধ করতে পারছে না। মিছিলকারীরা এ জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন। এতে সরকারও ঠান্ডা মাথায় এমনি সব খুন-হত্যার দায় এড়াতে পারে না। ভারত ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য কোন দেশেও যদি এমন ঘটনা ঘটে তার দায় ঐ দেশের সরকারের ওপরই বর্তাবে। পশু-পাখিও তার সন্তানের নিরাপত্তা দিতে নিজের নিরাপত্তাকে থোরাই কেয়ার করে কিন্তু মানুষ পুত্র সন্তানের আশায় কন্যা সন্তানকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। ঐ মিছিলকারী যুবকদের নিয়ে অনেকেই প্রাথমিকভাবে হয়তো ঠাট্টা করেছেন কিন্তু গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তারা মানব সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সংশ্লিষ্ট ডিসির কাছে চিঠি দিয়ে মহারাষ্ট্র তথা ভারতীয় সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন। ধরা যাক একাত্তরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কথাই। একাত্তরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতকে বিশ্বদরবারে এক অনন্য স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিলেন সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। তাকে যদি গর্ভেই শেষ করে দেয়া হতো তাহলে কেমন হতো তা কি একটিবারও ভাবা যায়? ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল, আজকের বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে যদি তাদের বাবা মা গর্ভেই যদি মহারাষ্ট্রের মতো হত্যা করা হতো তাহলে কেমন হতো? আজকে ভারত দাবী করে এবং সেটাই সত্য যে আজকের আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের পূর্ব পুরুষেরা ভারতীয় ছিলেন।
এই কমলা আজ ভারতের গর্ব। আর শুধু ভারতই বা কেন, পাকিস্তানও তো দাবী করে কমলা তাদেরই লোক। এই গর্বকে যদি গর্ভে খুন করা হতো তাহলে কি একটা সম্ভাবনাকেই গলা টিপে হত্যা করার সামিল হতো না?
এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশেও কি কখনো কখনো এমনি ঘটনা ঘটে না। ঘটলে আজ আমাদের কতো আফসোস করতে হতো একটি বার ভেবে দেখুন! আমরা কথায় কথায় আচারে-অনুষ্ঠানে বলে বেড়াই ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরিয়সী’ ‘মায়ের পায়ের তলায় বেহেস্ত’ ইত্যাদি। কিন্তু আজকের ছাত্রী ভবিষ্যতের জননী বা আজকের মায়েদের প্রতি সমাজের যে আচার-আচরণ-ব্যবহার তাকে অনেকটাই স্ববিরোধী বলেই মনে হয়। সাম্প্রতিককালের কয়েকটি পত্রিকার কয়েকটি খবরের শিরোনামই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যেমন- ‘ছাত্রীদের বিক্ষোভে শিক্ষক বদলি, যৌন নির্যাতনের অভিযোগ (‘দেশ রূপান্তর ২.১.২০২৩) শিরোনামের ভেতরের খবরটি হলো- অভিযুক্ত শিক্ষক চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারস্থ কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আলাউদ্দিন। স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন উক্ত প্রধান শিক্ষক নাকি ছাত্রীদেরকে বিভিন্ন কৌশলে যৌন নিপীড়ন করতেন। এরকম কুকর্ম করতে গিয়ে ছাত্রীদেরকে ভয়ভীতি দেখাতেন। তার কথায় রাজি না হলে ছাত্রীদেরকে ফেল করিয়ে দেয়া সহ বহিষ্কারের হুমকি দিতেন। এমন কি নারী অভিভাবকরাও নাকি তার কুদৃষ্টি থেকে রেহাই পেতেন না। ছাত্রীরা সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেও কোন বিচার না পাওয়ায় তারা আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। এক ছাত্রীর অভিযোগ হলো- স্কুলের ম্যাডামরাও নাকি কেউ তার রুমে একা যেতেন না। ঐ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নাকি ঐ শিক্ষকের মুখে বই, খাতা, কলম, পানির বোতল ছুড়ে মারে। এখন প্রশ্ন হলো এতো মারাত্মক অভিযোগ যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার বিচার তো হলোই না বরং তাকে দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে সংযুক্তির আদেশ দেয়া হয়েছে। এটা ক্যামন বিচার? এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীতভাবে প্রশ্ন রাখছি, উক্ত প্রধান শিক্ষক তার নতুন কর্মস্থলে যোগদানের পর সে যে তার স্বভাব বদলাবে সে নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? তার বদলির আদেশ শুনে পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষার্থীরা কি আতঙ্কিত হবে না? কাউকে না কাউকে তো এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। তা না হলে সামাজিক পতনের পথ কি কেউ রোধ করতে পারবে। তবে সমাজকে তো বাঁচাতেই হবে। এ প্রসঙ্গে দৈনিক জনকন্ঠের (১.১.২০২৩) একটি শিরোনাম হলো- ‘বিদায়ী বছরে ৯৩৬ নারী ধর্ষিত।’ দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার (৩.১.২০২৩) শিরোনাম- সিলেট অঞ্চলে নারী হত্যা বেড়েছে, এক বছরে প্রাণ গেলো ২৮ নারী ও ৫ শিশুর’। ২৯.১২.২০২২ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ লিখে- ‘ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার’। এমনি অবস্থায় যেভাবে ভারতে মেয়ে সন্তান হত্যা করা হচ্ছে মাতৃগর্ভে আর বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে নারী হত্যা বাড়ছে তাতে নারী পুরুষের ভারসাম্য বজায় রাখা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কাই তো বাড়ছে। যা কখনো কাম্য হতে পারে না। তাই পৃথিবীর যে যে দেশে এমন অবস্থা সে সে দেশের শাসন ব্যবস্থায় নারী হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করতেই হবে। নইলে মাতৃজাতির প্রতি যে সুবচন বর্ষণ করা হয় তা একদিন নির্বাসনে যাবেই। আর পৃথিবী যদি ‘মা’ শূন্য হয়ে যায় তাহলে ‘পিতা’ শব্দেরও কোন অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটনা দেশে- সমাজে অহরহ ঘটেই চলছে। কিন্তু যখন দেখা যায় শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন করার খবর প্রকাশ পায় তখন সেটাকে অন্যরকম এক অশনিসংকেত বলেই মনে হয়। মনে হয় সমাজ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন শিক্ষক যে মানেরই হোন না কেন তারা সমাজে ‘স্যার’ বলেই পরিচিতি লাভ করেছেন। এই ‘স্যার’ সমাজের কিছু কিছু ‘স্যার’ এর ব্যবহার যখন ‘ষাড়ে’র মতো হয় তখন সেটাকে দুঃখজনক ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়।
এরকম দুঃখজনক অবস্থা থেকে উত্তরণ একমাত্র ‘স্যার’দের দ্বারাই সম্ভব। সম্মানিত স্যারদের কাছে সমগ্র সমাজের প্রত্যাশা- অন্তত স্যার নামের কলঙ্কদের নোংরা হাতের স্পর্শ থেকে যেন ‘স্যার’ সমাজের মান-ইজ্জত রক্ষা করতে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসেন। স্যারদের বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন স্যারদেরই লজ্জার কারণ।
এমনি অবস্থার অবসান সকলেরই কাম্য।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।