প্রসঙ্গ : কর্মজীবী মহিলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:০০:২১ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
লেখাপড়া করেও, বিদ্যাবুদ্ধি সম্পন্ন হয়েও মানুষ একা বাস করতে পারে না; একা থাকতে পারে না। বিশেষ করে পরিবার সংসারে নিজেদের লোকজন ছাড়াও অন্য লোকের দরকার হয়। গৃহিনীরা সংসারের ধকল একা সামাল দিতে পারেন না। এখানেই কাজের বুয়ার দরকারটা সামনে আসে। কাজের বুয়া ছাড়া শহরের জীবন অচল হয়ে পড়ে। শহরে বুয়াদের কদর বেশি। ফ্রিজে মাছ, মাংস, সবজি থাকলেও গৃহিণীরা বুয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেন। সকালে বিছানায় থেকে গৃহিণীরা বুয়ার ডাকের অপেক্ষায় থাকেন। অভিজাত পরিবারে ঘুম ভাঙ্গে কাজের বুয়ার কলিং বেলের আওয়াজে। পূর্বে কলিং বেলের কাজ করতো পাখির কলকাকলি বা মোরগের ডাক।
বুয়াদের জীবনে এতটুকু আরাম-আয়েস নেই। তাদের জীবন কলের মতো। কাক ডাকা ভোরে তারা শয্যা ত্যাগ করেন, ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক তার তোয়াক্কা না করে কর্মস্থলের দিকে ছুটেন। বাসায় পৌঁছে নাস্তা তৈরি করেন। সবাইকে নাস্তা করান, চা খাওয়ান। নিজ ঘরে যাদের রেখে এসেছেন, তাদের কথা মনে হয়। তারা উপোস করে আছেন, পান্তাও হয়তো তাদের জুটে না। তখন গোপনে চোখ মোছেন।
পূর্বে কাজের বুয়া ব্যবস্থা ছিল না। মা-ঝি’রা মিলে ঘরে কাজ করে নিতেন। দাওয়াত-নিমন্ত্রণ থাকলে নিমন্ত্রিতদের কেউ কেউ আগে ভাগে এসে পড়তেন এবং কাজে সহযোগিতা করতেন। এভাবেই সংসার-পরিবার চলতো। পরে পরিবর্তন এসেছে এবং কাজের বুয়ার প্রচলন হয়েছে। এখন কাজের বুয়া ছাড়া সংসার একেবারে অচল। এতে গৃহিণীরা অলস ও আরামপ্রিয় হয়ে ওঠেছেন। আগে যেখানে সব কাজ করতেন, এখন বুয়ার কোনো অসুবিধায় একদিনও চলে না। বুয়াদের কাজ দুই ভাগে বিভক্ত। মাছ-মাংস-তরিতরকারি কাটা ও বানানো সহ রান্না ঘরের যাবতীয় কাজ করেন একজন। অন্যজন কাপড় ধোলাই করা, ঘর ঝাড়ু দেওয়া মোছা-মুছি করেন। কেউ কেউ দুটো কাজই একসঙ্গে করেন। কেউ কেউ দুই পর্যায়েও করেন। কোনো অসুবিধায় বুয়া আসতে দেরি হলে বা না এলে রান্না বান্নাও আটকে থাকে।
একটা সময় ছিল যখন কাজের বুয়া নামে কোনো শব্দই ছিল না। সে সময় মহিলারা নিজ ঘরের সব কাজ স্বাচ্ছন্দে করে নিতেন, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্ন করে নিতেন। স্বামীর সেবা-যত্ন করেও বাইরের কাজ যেমন উঠান ঝাড়ু দেওয়া, ফুল গাছের যত্ন প্রভৃতি বাড়ির গৃহিণীরা সহজেই করে নিতেন। বর্তমানে সেই পরিবেশ নেই। বুয়া ছাড়া এখন চলে না।
সমাজে বুয়াদের কদর বেড়েছে, ইজ্জত বেড়েছে। বুয়াদের এখন গৃহকর্মী, গৃহপরিচারিকা, গৃহ সহায়য়িকা বলা হয়। কাজের বুয়ার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। ‘কাজের বুয়া’ এখন একটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে, কলেজে পড়ছে, ভালো চাকরি করছে, অভিজাত ঘরের ছেলে-মেয়েরা তাদের বন্ধু। তাদের মা-বাবার ছোট বা নিচু পর্যায়ের চাকরির কথা প্রকাশ করতে তাদের বাধে, লজ্জা করে। মা-বাপের যাই হোক, শিক্ষিত চাকরিজীবী ছেলে মেয়েরা এখন আভিজাত্যের পর্যায়ে।
কাজের বুয়ারা আমাদের সমাজেরই লোক। তাদের ভালো-মন্দ আছে, রোগ-বিমার আছে, ক্লান্তি আছে। গৃহিণীরা, গৃহকর্তারা এসবে পাত্তা দেন না। অথচ তারাও আমাদের মতো ভালোভাবে, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার দাবিদার। সমাজের বিত্তবানদের কাছে তাদের হক আছে, আবদার আছে, পাওনা আছে।
বছরে আমাদের দু’টি আনন্দের উৎসব আছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এ উপলক্ষে নতুন কাপড় পরার, একটু ভালো খাবার খাওয়ার অধিকার আছে। বিত্তবানরা একটু সহানুভূতির দৃষ্টি দিলে, আনন্দের একটু ভাগ দিলে তারা সিড়ি হতে পারে বিত্তবানদের আরো ভালো অবস্থানে যাওয়ার।
কাজের বুয়ারা একসময় বয়সের কারণে বা অন্য কোন কারণে কাজ থেকে অবসরে চলে যেতে হয়। এসময় তাদের খালি হাতে বিদেয় না দিয়ে এককালীন কিছু অর্থ তাদের হাতে তুলে দিলে তারা যেমন খুশি হবেন, তেমনি সম্মানবোধ করবেন। সাথে একসেট নতুন কাপড় দান করতে পারলে আরও ভালো হয়।
লেখক : সিনিয়র কলামিস্ট।