মার্কিন ভণ্ডামি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:১২:৫১ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
‘মার্কিন ভণ্ডামি’। ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকীয় বিশ্লেষণ এটা। ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের হত্যাকাণ্ড। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু রাতারাতি বদলে দিয়েছে করোনা আক্রান্ত নিস্তক আমেরিকাকে। একেতো করোনার থাবায় এক লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি, তার উপর বর্ণবিষেষ বিরোধী আন্দোলন পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে।
ঘটনাটি ছিল সাদামাটা। বছর ছেচল্লিশের জর্জ ফ্লয়েড একটা দোকানে ঢুকেছিলেন সিগারেট কিনতে। ওই দোকানের এক কর্মচারীর অভিযোগ, ফ্লয়েড ২০ ডলারের একটা জাল নোট ব্যবহার করেছিলেন। ওই কর্মী যখন তা বুঝতে পারেন, ফ্লয়েড ততক্ষণে দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই কর্মী দোকানের বাইরে বেরিয়ে আসেন। দেখেন ফ্লয়েড তাঁর গাড়িতে বসে। তাকে জাল নোটের ব্যাপারে জানালে ফ্লয়েড অস্বীকার করেন, দোকানকর্মী সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ডাকেন । মুহূর্তে পুলিশ ছুটে আসে। ফ্লয়েড পুলিশের কাছেও অভিযোগ অস্বীকার করেন। ওই দোকানের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে, এরপরই উত্তেজিত হয়ে পড়েন ওই শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্তা তেরেক শভিন। ফ্লয়েড ‘অপরাধী’, এমন কোনও তথ্য পুলিশের কাছে ছিল না, হাতের কাছে কোনও অস্ত্রও ছিল না, কাউকে মারতেও উদ্যত হননি, তবু ফ্লয়েডকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে, তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে, নৃশংসের মতো তাঁর ঘাড় নিজের হাঁটু দিয়ে সজোরে চেপে ধরেন শভিন। সেই চাপ বাড়তেই থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে। ফ্লয়েড শেষ মুহূর্তে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আই কান্ট ব্রিদ’- আমার দম আটকে আসছে, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। ফ্লয়েডের জীবনের বাতাস কেড়ে নিয়েছিলেন ঐ শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্তা।
ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। ভাবুন একবার, হাসপাতালে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাসের আগে করোনা আক্রান্ত কোনও মানুষ ঠিক যেমন আর্তনাদ করে ওঠেন- দম আটকে আসছে…। শ্বাস নেওয়ার কী করুণ আকুতি। ঠিক এমন করেই তো আমেরিকার জনগণ শহরে শহরে আগুন জ্বেলে লাখ আমেরিকানের মৃত্যু আর অসহ্য অর্থনৈতিক কষ্টের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দায়ী করে বলছেন, ‘আর শ্বাস নিতে পারছি না’।
মহামারি আর বঞ্চনার জালে আটকে যাওয়া সব দুর্গত মানুষের হৃদয়ের আওয়াজটাই জর্জের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে, ‘আমার দম আটকে আসছে’। এ তো দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের যন্ত্রণার কথা। বৈষম্য থাকলেই বিপ্লব হয় না। কিন্তু হঠাৎ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা মানুষ খিদের জ্বালায় দিশাহীন হয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে পারে। বৈষম্যের সমাজটা হল ‘মাইনফিল্ড’-এর মতো। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকে তলায় অসন্তোষের “বোমা”। কখন কোনটার উপর কার পা পড়বে, আর তখন কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটবে, তার পূর্বাভাস জানা কোনও রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব নয়। আবার কখন কোন আর্তনাদ বোঝা হয়ে থাকা মানুষের মুখে প্রতিবাদের ভাষা ফোটাবে তা-ও আগাম বলা যায় না। শিল্পায়নের প্রথম যুগে শ্রমিকরা যন্ত্রণা সইতে না পারলে কারখানা ভাচুর করত, আধুনিক সভ্যতার বঞ্চিত মানুষ দোকানপাটে হামলা চালায়, লুটপাট করে। তফাত এটাই।
বিক্ষোভকারীরা কারা? তারা শুধু ফ্রয়েডের মতো বৈষম্যের শিকার কালো বা বাদামি মানুষ নন- ভীষণ বৈষম্যপূর্ণ আমেরিকান অর্থনীতির সৌধ যাদের মাথার উপর ভেঙে পড়েছে, তারাও নেমেছে রাজপথে। যে এক লাখের বেশি মার্কিন নাগরিক করোনার ছোবলে জীবন হারিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ও গরিব মানুষেরাই বেশি এঁরা তাদেরও স্বজন, তাদের মতোই বিপন্ন। আরব বসন্তের স্ফুলিঙ্গ জ্বালানো তিউনিসীয় ফেরিওয়ালা মহামের বুয়াজিজির মৃত্যুর কথা মনে আছে? জর্জ ফ্লয়েড যেন সেই রকম মার্কিন বিক্ষোভের প্রতীক নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলাম লেখক রেক্সোনা গে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে লিখেছেন : ‘করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আজ না হয় কাল হবেই। কিন্তু আমেরিকার মতো মহান দেশে বর্ণবিদ্বেষের যে বিষাক্ত ভাইরাস ছড়িয়ে আছে, তার টিকা কি আবিষ্কার করা যাবে? শুধু হ্যাশট্যাগের বর্ণবিদ্বেষ বিরোধিতা কি আমেরিকাকে রক্ষা করতে পারবে?’
আমেরিকার কালো মানুষেরা চারশো বছর ধরে অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন। দুশো বছর শিকার হয়েছেন দাস প্রথা নামে বর্বরধারায়। আর আরও একশো বছর ধরে তীব্র বর্ণবৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের। তাঁদের মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। শুনলে অবাক হবেন, কোথাও কোথাও আজও শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গদের বাথরুম, এমনকি জলের কলও পর্যন্ত আলাদা।
আমার দম আটকে আসছে’ প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীরা হোয়াইট হাউসের বাইরে। কার্ফিউ ভেঙেই নিউ ইয়র্ক, আটলান্টা, লাস ভেগাসের রাস্তায় রাস্তায় দেদার ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা। সেই ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের হত্যার পর যে বিশাল জনরোষ আমেরিকার বিবেককে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল, আজ আরও একবার যেন সেই জনরোষের প্রতিচ্ছবি। এই ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যসঙ্কটের মধ্যেও লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব অগ্রাহ্য করে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী নেমেছেন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক রাস্তায় ফ্রয়েডের ওপর পুলিশের বর্বরতার প্রতিবাদ জানাতে।
মিনিয়াপোলিসে নিরস্ত্র ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে চেপে ও ডালাস, এমনকি ছোটো শহরেও যেখানে পুলিশের সশস্ত্র পুলিশ অফিসারের মেরে ফেলার ছবি দাড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়। বিশ্বের সর্বত্র মানুষ এই আমেরিকাকে দেখে স্তম্ভিত। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করা মার্টিন লুথার কিংয়ের হত্যাকাণ্ডের ৫২ বছর পর আজ আমেরিকার একটা রিপোর্ট বলছে, মিনিয়াপোলিস থেকে শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ভিসি, পশ্চিমে লস অ্যাঞ্জেলেস, সানফ্রান্সিসকো, দক্ষিণে হিউস্টন অত্যাচার ও হত্যার ঘটনা বহু বার ঘটেছে। শুধু জর্জ ফুয়েত নন, ২০১৩-১৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় ৭,৬৬৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আছে সাউথ ক্যারোলিনার চার্লস্টন, যেখানে ২০১৪ সালে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক মাইকেল ব্রাউনকে পুলিশ গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছিল। আছে নিউ ইয়র্কের রষ্কাস, যেখানে আফ্রিকার গিনি থেকে পড়াশোনা করতে আসা যুবক আমার নিরালোকে বিনা কারণে পুলিশ রাতের অন্ধকারে গুলিতে ঝাঁঝরা করে নিয়েছিল। আছে নিউ ইয়র্কের সেন্স, যেখানে বিয়ের আগের রাতে ব্যাচেলর্স পার্টি করে বেরনোর সময় কৃষ্ণাঙ্গ যুবক শন বেলকে পুলিশ খতম করে দিয়েছিল। মোট মাত্র ১৩ শতাংশ কালো মানুষের বাস হলেও, পুলিশি অত্যাচারে মৃতের সংখ্যা সাদা চামড়ার মানুষের থেকে প্রায় আড়াই গুণ বেশি। কিছু কিছু অঞ্চলে আরও বেশি। যেমন মিনেসোটাতে। যেখানে জর্জের বাড়ি, সেখানে ৪ গুণ। এক সময় আমেরিকা ছিল শিল্প-কারখানার দেশ। কিন্তু গত হওয়া নতুন কর্মসংস্থানের তিরিশ বছরে দেশটা হয়েছে রেস্টুরেন্ট, আর বিনোদন পরিসেবার দেশ। উৎপাদন চলে। গিয়েছে চিনে বা অন্য কোথাও। বিনোদন-ব্যবসায় মজেছে মার্কিনিরা। এদিকে করোনার হানায় গত তিরিশ বছরে তৈরি ক্ষেত্রগুলো ধসে গিয়েছে। করোনা বিধ্বস্ত আমেরিকায় বেড়েছে। তাই কোনো না-কোনো অঘটনের ধাক্কায় পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। সিস্টেম যদি বিভ্রাটে পড়ে বা ম্যালফাংশন করে, তাহলে শান্তির কলও ম্যালফাংশন বেকারত্ব লাফিয়ে লাফিয়ে কনজিউারিজমের উৎসব হল ‘শপিং স্প্রি’ বা উদ্দাম কেনাকাটা। অথচ দোকানে ধরে ধরে জিনিস সাজানো কিন্তু কিনতে পারছে না। অনেক মানুষ। ওই সব দোকানের সেলসম্যানরা বেতন পাচ্ছেন না। সরকার দরিদ্রদের জন্য যে ১২০০ ডলারের চেক দেবে বলেছে, তা পাওয়ার শর্ত পূরণ করাও কঠিন। ফলে অনেকেরই জুটছে না মাইনফিল্ড বিস্ফোরিত হয়েছে সরকারি সাহায্য। ফলে আগে থেকে সামাজিক জর্জের হত্যাকাণ্ডে।
এই অবস্থায় লিখলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জ্বলন্ত দেশের আগুনে ঘি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিষাক্ত বিষেষ নিয়ে ট্যুইটার লিখলেন ‘হোয়েন দ্য লুটিং স্টার্টস, দ্য শুটিং স্টার্টস’ (লুটতরাজ শুরু হলে গুলিও শুরু হবে।) পাড়ার মাস্তানদের ভাষায় বললেন, ‘কুকুর লেলিয়ে দেব। ঠান্ডা করে দেব ওই সব আন্দোলনকে।’ ঠান্ডা তো দূরের কথা, আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল আন্দোলন। হিংসা, লুটপাট, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আগুন জ্বলছে কেন?
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ আমেরিকানদের বলেছিলেন, ‘গো শপিং’। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আর কোনও পথ তাঁর মাথায় আসেনি হয়তো। কিন্তু এটাই সত্য যে, কনজিউমারিস্ট সমাজে শপিং মানে সমাজের বিকল্প সামাজিকতা, ‘ব্যাক টু নরমাল’ ট্রাম্পও তা-ই বলেছেন। কিন্তু হাতে টাকা না-থাকা মানুষরা ‘নৈরাজ্য’-এর পথে’ শপিং’ করছে। ‘শপিং ফর ফ্রি’- নিখরচা কেনাকাটা। যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘লুট’। কনজিউমারিজমের মুদ্রার এক পিঠে ‘শপিং স্প্রি’ থাকলে আরেক পিঠে থাকে এই ‘শপিং ফর ফ্রি’।
মার্কিন মুলুকে সেই ছোটোবেলা থেকেই শেখানো হয়, কেনাকাটাই আনন্দ, কেনাকাটাই নিরাপত্তা, কেনাকাটাই শক্তি। শপিং মল হল, আধুনিক বাজার ব্যবস্থার তীর্থ। যা কি না সব অসুখ সারাবার ওষুধের দোকান। কে না জানে, মানুষ তার সবচেয়ে কাঙ্খিত জিনিস হাতের মুঠোয় না-পেলে একসময় ঘৃণা করা শুরু করে। লন্ডন ও প্যারিস দাঙ্গার পর মার্কিন দাঙ্গায় শপিং মল পোড়ানোর হিড়িক আসলে সুখের দোকানে ঢুকতে না-পারা, অযোগ্য ও বাতিল হয়ে যাওয়া ক্রেতাদের অসুখী আক্রোশ। তার উপর লিঙ্কন আর লুথারের নির্মিত সমতার মানচিত্র থেকে দিনান্তের আলোর মতোই হারিয়ে যাচ্ছে, বহুজাতিক আমেরিকা। এই আমেরিকাই কি আমাদের সেই চেনা আমেরিকা, যার জন্য গর্ব বোধ করা যায়? এই নতুন আমেরিকাকে আমরা চিনি না। আমাদেরও দম আটকে আসছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।