মেগা প্রজেক্ট বনাম দ্রব্যমূল্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:০১:১৯ অপরাহ্ন
গোলাম সারওয়ার
পদ্মাসেতু যখন চালু করে দেওয়া হয়, তখন বৃহত্তর সিলেটে প্রবল বন্যা। ১৮ জুন শনিবারের বন্যায় সিলেট শহর শুধু নয় আশপাশ প্রতিটা অঞ্চল তলিয়ে যায়। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় সাধারণ মানুষকে। সাধারণ থেকে অসাধারণ মানুষগুলো ক্ষয়ক্ষতি থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেলেও ভয়াবহ বন্যাকে ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
২১ জুন দেশের প্রধানমন্ত্রী আকাশ পথে হেলিকপ্টারযোগে নেত্রকোণা হয়ে সুনামগঞ্জ এবং সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অবলোকন করেন। সে সময় মাত্র ৬০ লাখ টাকার চেক জেলা প্রশাসকের কাছে তুলে দেন বন্যার ত্রাণ হিসেবে। সরকারি ত্রাণের অপ্রতুলতায় বেসরকারি পর্যায় থেকে ব্যাপক ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। দুর্গত মানুষেরা সরকারি মানুষ থেকে বেসরকারি মানুষগুলোকে কাছে পেয়েছে।
বেসরকারি এক সংস্থার হয়ে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। আমাদের সংস্থাটি প্রতিদিন দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণ নিয়ে গেছে। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আমাদের যতোটুকু সামর্থ্য ছিল ত্রাণ বিতরণ করেছি। ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের দান দক্ষিণায় বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
দেশের ৪৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সে সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১০৪ কোটি টাকা জমা হয়েছিল। সেই ত্রাণ থেকে কতোজন দুর্গত মানুষ তার ঘরবাড়ি বানাতে সক্ষম হয়েছিল, তা অবশ্য আজও জানা যায়নি।
পদ্মাসেতু যে বৎসর উদ্বোধন হয়, সেই একই বছরে ঢাকায় নির্মিত মেট্রোরেল উদ্বোধন হয়। বলা যায়, ২০২২ সালে এ দুটি বড় অর্জন ছিল। পদ্মাসেতুতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল, প্রায় একই পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে মেট্রোরেল নির্মাণেও। এ দুটি বড় কাজ সম্পন্ন করতে সরকারের ব্যাপক ব্যয় হয়েছে, তা সহজেই বলা যায়। তবে এ দুটি কাজ সম্পন্ন করতে অনেক পরিবারও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ যে হয়েছে, সেটিও খুব সহজে বলা যায়।
তা না হলে, এতো কিছুর পরেও দেশে যে চরম অবস্থা বিরাজ করছে, বুঝার কোনো উপায়ই নেই। শহরের রাজপথে কিংবা অলি-গলিতে দিন দিন দামি দামি গাড়ি বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে মোটর বাইক, বেড়েই চলেছে সিএনজি অটো-রিকশা, বেড়েই চলেছে বাস-ট্রাক, বেড়েই চলেছে দামি দামি বাড়ি নির্মাণের প্রতিযোগিতা, বেড়েই চলেছে নিত্য-নতুন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাল-খাতা ইত্যাদি।
পেট্রোল-অকটেনের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ পার্সেন্ট। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে বেশ কয়েকবার। আর সবকিছুর প্রভাব পড়ে ওই দ্রব্যমূল্যের ওপর। তবুও মানুষ ক্রয় করতে পারছে। ক্রয় করতে পারতে হয়। না হলে জীবন চলে না। ক্রয় করার সামর্থ্য অর্জন, বৈধ কিংবা অবৈধ- যেভাবেই হোক মানুষ তা করছে।
চিচিং ফাঁক বলে একটা কথা ছিল। এখন আর চিচিং ফাঁক বলে কোনো কথা নেই। সবকিছুই এখন চিটিং ফাঁক। বড় বড় কোম্পানি থেকে শুরু করে ছোট দোকানী বা ফড়িয়া ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই মানুষের সাথে চিট করে যাচ্ছে। অবলীলায় চিট করে যাচ্ছে। প্রতারণা করে যাচ্ছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের দোহাই দিয়ে, পেট্রোল-ডলারের সংকট দেখিয়ে কিংবা গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির দোহাই তুলে অথবা প্রতি বছর বাজেটের দোহাই দিয়ে এদেশের দ্রব্যের দাম বাড়ে। কখনও কখনও এমনিতেই দ্রব্যের দাম বাড়ে। রোজা-রমজানের দিনে তো দ্রব্যের দাম বাড়েই বাড়ে- সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
না, এদেশে কোনো নিয়ন্ত্রক নেই। যিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনিও তো বড় ব্যবসায়ী। হয় সরাসরি ব্যবসায়ী, নয় পার্সেন্টেজ ব্যবসায়ী। ব্যবসার স্বার্থ কি উপেক্ষা করা যায়? দেশের সাধারণ মানুষ গোল্লায় যাক, দেশের সাধারণ মানুষ না খেয়ে মরুক, কিংবা বস্ত্রহীন হয়ে থাকুক, তাতে কার কি? দেশের মানুষ চোর হোক, ডাকাত হোক, তাতেও বা কার আসে যায়?
চিটিং এর কথা এবার সরাসরি উদাহরণ দেয়া যাক। দেশের ৭টি কর্পোরেট কোম্পানি সকল প্রকার পণ্য আমদানি করে। এরা ইচ্ছেমতো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে। কখনও কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে আবার কখনও সরকারি ত্রাণে অর্থ সরবরাহ করার ফলে দ্রব্যের ওপর দাম বসিয়ে দেয়। পাবলিক সেন্টিমেন্টকে মাথায় রেখে তখন চিট করে। কিভাবে? পণ্যের দাম ঠিক রাখতে গিয়ে বা পূর্বমূল্য বহাল রাখতে গিয়ে এরা ওজনে কম দেয়। ধরেন, ১০০ গ্রাম বিস্কুটের মূল্য ১০ টাকা ছিল, এখনও ১০ টাকাই, কিন্তু ওজন ১০০ গ্রাম নয়। ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম বিস্কুটের মূল্য এখন ১০ টাকা। চিটিংবাজির যে রকমফের হয়ে গেছে ছোট বাচ্চাটাও এখন টের পায়।
বাজারে এমন কোনো জিনিস এখন আর নেই, যেখানে ভেজাল মিশ্রিত করা হয় না। সব পণ্যেই এখন ভেজাল, অরিজিনাল বা অর্গানিক বলতে এখন আর কিছুই নেই। কমলা কিনতে দেখুন কমলার সাথে কেনু দিয়ে দিচ্ছে! দাম কিন্তু কমলারই রাখছে।
তীব্র শীতে গুড়ের পিঠা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে? গুড় কিনতে যান, অরজিনাল বলতে কিছুই পাবেন না। সবই ডুপ্লিকেট। ডুপ্লিকেট করতে করতে আমাদের মাথাটাই এখন ডুপ্লিকেট হয়ে যাচ্ছে।
ব্যাংকে ১ লাখ টাকার ওপরে জমা রাখতে যান কিংবা ৫০ হাজার টাকার ক্রস চেক নিয়ে যান টাকা তুলতে, দেখবেন ক্যাশিয়ার আপনার কাছে ন্যাশনাল আইডির ডুপ্লিকেট চাচ্ছে। ন্যাশনাল আইডির নাম্বার রাখলেই তো হয়। না, ওরা ফটোকপির পাহাড় জমাবে ব্যাংকে। কারণ, মাথা তো ডুপ্লিকেট হয়ে আছে। ফলে কাগজের অপচয় হচ্ছে, মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।
চিচিং ফাঁক নয়, চিটিং ফাঁকের সর্বশেষ কথাটি বলে আজকের লেখাটি শেষ করছি। প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে এখন শীতের তীব্রতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দিন দিন শীত বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। দিনে ৩ বার, ৪ বার করে এবং ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎহীন করে রাখা হচ্ছে সিলেট অঞ্চলকে। শীতে তো বিদ্যুৎ সঞ্চালন কম লাগে। ফ্যান চলে না, এসি চলে না। তাহলে লোডশেডিং কেন? বিদ্যুতের খুঁটি বসানো হচ্ছে- এমন যুক্তিই বা বছরের পর বছর কেন আমরা শুনবো? বিদ্যুৎ কর্মে চিটিং বাজি চলছে কি-না, এটাই এখন দেখার বিষয়। কিন্তু দেখবেটা কে?
লেখক : প্রাবন্ধিক।