ভোক্তা অধিকার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:০৩:২৬ অপরাহ্ন
মো. লোকমান হেকিম
আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই রোজার মাসে নানা ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে যায়। এ জন্য প্রতি বছর সরকারি পর্যায়ে এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। পণ্যের বাজারে যাতে কোনোভাবে ঘাটতি না থাকে এবং দাম বেড়ে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর। তার পরও ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন প্রতি বছর। এবার রোজার আগে দেশের অর্থনীতিতে বেশ টানাপড়েন আছে। তাই আশঙ্কারও কারণ আছে। রমজানে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, খেজুর, চিনি, গুঁড়াদুধসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আমদানি সহজ করতে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে এলসি খোলা সহজতর করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৭ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী আমদানিতে এলসি মার্জিন ছাড় দিতেও বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। গণমাধ্যমে এমন খবর আসছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সব আমদানিকারক এলসি খুলতে পারছেন না। কিছু বড় আমদানিকারক ওই সুবিধা পাচ্ছেন। ছোট আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ডলার সঙ্কটের অজুহাতে এলসি খুলতে গড়িমসি করছে। সব আমদানিকারক সমান সুযোগ না পেলে ভোগ্যপণ্যের আমদানি, সরবরাহ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কব্জায় চলে যাবে। সে ক্ষেত্রে তারা সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করবে এবং একতরফা দাম বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেবে এমন আশঙ্কাই বেশি। ভোগ্য পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ভোক্তারা খুবই কষ্টে আছে। এই মুহূর্তে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে তাদের আয়-রোজগার বাড়ানো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির বিকল্প নেই। ভোগ্য পণ্যের বাজারে এখন বহুমুখী সংকট। দেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় বিদেশে কোনো সংকট দেখা দিলে তার প্রভাব এখানেও পড়ে। করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেক পণ্য সরবরাহ কমেছে, যার ফলে অনেক ভোগ্য পণ্যের দাম এখন বেশ চড়া। এসব কারণে মূল্যস্ফীতিও বেশ ঊর্ধ্বমুখী। এই প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়ার আরেকটি কারণ হলো জাহাজভাড়া অনেক বেড়েছে। বহুদিন ধরে আমদানি ও রপ্তানির ভারসাম্যের মধ্যে আমদানি কম হয়েছে, রপ্তানি বেশি হয়েছে। ফলে দেশের রিজার্ভও বেড়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে আমদানির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এতে দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। ডলারের সংকট দেখা দিয়ে ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ভোগ্য পণ্যের আমদানি মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে।
বর্তমানে ভোগ্য পণ্যের ব্যবসাটি গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে চলে গেছে। যার কারণে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা না থাকায় মনোপলি সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা চাইলেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আমরা এখন দেখছি। এটি কোনোভাবেই ভোক্তাদের অনুকূলে নয়। বর্তমানে ভোক্তার অবস্থা খুবই নাজুক, বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ অনেকটা নাভিশ্বাস অবস্থায় আছে। উত্তরণের উপায় বলতে গেলে, এ অবস্থায় মানুষের আয়-রোজগার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমরা সব সময় দেখে আসছি, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ও বাড়বে, তারপর নতুন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় যাবে। এটা যুগে যুগে হয়ে আসছে। হয়তো সামনে এ রকম একটা মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসবে। ভোক্তার আয়ের পরিমাণ যদি তার ব্যয়ের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে ভোক্তার জীবনমানে সুবিচার হয়। আমাদের দেশের বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবার মধ্যেই এখন অতিমুনাফার প্রবণতা বেড়ে গেছে। লাভের প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ করে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, কখনো চিনির সংকট হয়, কখনো ভোজ্য তেলের সংকট হয়। সম্প্রতি আমরা নানা রকমের সংকট দেখেছি। এখানে কিছুটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে আমার মনে হয়। ব্যবসায়ীরা এখন আর স্বাভাবিক লাভের মধ্যে থাকতে চান না। যেকোনো উপায়ে লাভের পরিমাণ বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজারে যে বহুমুখী সংকট, এটা শুধু বাজার তদারকির অনুপস্থিতির কারণে হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। কিছু সমস্যা রয়েছে, যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করাও সম্ভব নয়, কারণ সেগুলো সরকার বা আমাদের ব্যবসায়ীদের আওতার বাইরে। তবে বাজার তদারকির প্রয়োজন আছে, সাপ্লাই চেইন যাতে ঠিক থাকে। নানা কারণে দাম বেশি বা কম হতে পারে, কিন্তু বাজারে যেন পণ্যের অভাব দেখা না দেয়।
যদি বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে ভোক্তারা কিন্তু আরো বিপদে পড়বে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কেউ যাতে অনৈতিকভাবে অতিমুনাফা করতে না পারে। এসব ক্ষেত্রে তদারকি আরো বৃদ্ধি করার প্রয়োজন আছে। শুধু খুচরা পর্যায়ে নয়, পাইকারি ও রিফাইনারি এবং উৎপাদন পর্যায়েও এই তদারকি করতে হবে। অন্য যেসব কারণে মূল্য পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে, সেই দিকগুলোতেও সরকার দৃষ্টি দিতে পারে। সরকারের উচিত হবে, নিত্যপণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রাখা, যাতে মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সংকট না থাকে। এটা সরকার করছে বলেই রিজার্ভের পরিমাণ কমছে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে যদি ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে আরো ভালো। বিলাসপণ্য আমদানি হ্রাস করে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে, তাহলে সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
লেখক : কলামিস্ট।