অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাপানি বিনিয়োগ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:৪২:৩১ অপরাহ্ন
ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
জাপান বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও ধনী দেশ। জাপান প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত উন্নত এবং জাপানের অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে থাকে। ২০১৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো প্রায় ২৪,১৮,৪২০ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিলো প্রায় ১৫,২৬,৪১০ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, চীন সহ বিশ্বের প্রচুর সংখ্যক দেশে জাপানের বিনিয়োগ রয়েছে এবং এ সকল বিনিয়োগের ফলে সে সকল দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাপানের বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হলো। ২০২২ সালের প্রথম অর্ধে, থাইল্যান্ডে জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৮,২৪৭ কোটি টাকা। এ সময়ে ২৮৪ জন বৈদেশিক বিনিয়োগকারী থাইল্যান্ডে বিনিয়োগ করেন এবং এর মাঝে জাপানী বিনিয়োগকারী ছিলেন ৭১ জন। এ সময়ে ৩,১৬৪ জন থাইল্যান্ডের নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স, কেমিক্যাল, বায়োপ্লাস্টিক প্রভৃতি খাতে থাইল্যান্ডে প্রচুর জাপানী বিনিয়োগ হয়েছে। আকর্ষণীয় এবং স্থিতিশীল বিনিয়োগ নীতি, জাপান ও থাইল্যান্ডের মাঝে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের চুক্তি, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, থাইল্যান্ড ও জাপানের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রভৃতির কারণে থাইল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণ জাপানী বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আশিয়ান দেশগুলোর মাঝে জাপান থাইল্যান্ডে সর্বাধিক (৩৬%) বিনিয়োগ করেছে। ২০১৬ সালে জাপানের মোট বিনিয়োগের ৩৬% ছিলো থাইল্যান্ডে। জাপানীর বিনিয়োগের ফলে থাইল্যান্ডে কৃষি এবং শিল্প বিকাশ লাভ করেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে।
এবার আসা যাক মালয়েশিয়া প্রসঙ্গে। ২০২১ সালে মালয়েশিয়ায় জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৯,৮৬০ কোটি টাকা। কিছু দিন পূর্বে মালয়েশিয়া প্রায় ২২,৩৬৭ কোটি টাকা জাপান থেকে বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসেবে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ অর্থ মালয়েশিয়ার ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেকট্রিক্যাল শিল্প, আই.টি, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ১,৪০০ এর অধিক জাপানী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১৯ সালে মালয়েশিয়ায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৯৫,১৬০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে মালয়েশিয়ায় প্রধান বিনিয়োগকারী দেশগুলো হলো চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় অধিবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রামের ব্যবস্থা, স্থানীয় বিক্রেতাগণের উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, মালয়েশিয়ার বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মিশন প্রভৃতির কারণে জাপান মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রক্শা করেছে। জাপানের বিনিয়োগ মালয়েশিয়ার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
এবার আসা যাক ফিলিপাইন প্রসঙ্গে। ২০১৯ সালে ফিলিপাইনের অর্জিত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৯০,২০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জানুয়ারী থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জাপান প্রায় ৩,৩৬৮ কোটি টাকা ফিলিপাইনে বিনিয়োগ করে যা সে সময়ের প্রাপ্ত বিনিয়োগের ৩১.৯২%। ফিলিপাইনের বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোনগুলোতে ৮৯১টি জাপানী প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত জাপানী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১,৪১,৫০৪ কোটি টাকা ফিলিপাইনে বিনিয়োগ করেছেন যা ফিলিপাইন অর্থনৈতিক জোনগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগের ২৭.৫২%। ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ, ইংরেজিতে কথা বলতে সক্ষম যুবশ্রেণীর শ্রমবাজার, বিনিয়োগ বান্ধব আইন এবং নীতি ইত্যাদির কারণে ফিলিপাইন জাপানী বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
ভারতে বিনিয়োগকারী দেশসমূহের মাঝে বিনিয়োগের পরিমান অনুযায়ী জাপানের অবস্থান পঞ্চম। ২০০০ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতে জাপানের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৩,৯৬,৫৫২ কোটি টাকা। বর্তমানে ভারতে ১,৪৫৫ টি জাপানী প্রতিষ্ঠান পরিচালিত রয়েছে।
২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রাপ্ত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৩০,১৬০ কোটি টাকা। জাপান এক্রটার্নাল ট্রেড অরগানাইজেশন এর তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৩৪টি জাপানী প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এদের প্রায় ৭০% প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে।
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অরগানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আশানুরূপ নয়। দক্ষ জনবলের অভাব বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির একটি অন্যতম অন্তরায়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে জাপান টোবাকো ইন্টারন্যাশনাল আমাদের দেশের আকিজ গ্রুপের টোবাকো ব্যবসাকে প্রায় ১৫,৬০০ কোটি টাকা প্রদানের মাধ্যমে আয়ত্ব করে নেয়। ২০১৮ সালে হোন্ডা মুন্সিগঞ্জের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট শুরু করে। বাংলাদেশ সরকার এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সির মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ জেলায় আড়াইহাজার উপজেলায় ১,০০০ একর জমির উপর জাপানিজ ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠিত হবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসে জাপানিজ ইকোনোমিক জোনে উৎপাদন শুরু হতে যাচ্ছে। জাপানের বিখ্যাত মিট্সুবিশি নামক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। জাপান আশা করছে জাপানিজ ইকোনোমিক জোনে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ১৬,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ অর্জন সম্ভব হবে। জাপানিজ ইকোনোমিক জোনে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে প্রায় ১ লাখ মানুষের। ইতিমধ্যে ৪০টি কোম্পানী জাপানিজ অর্থনৈতিক জোনে কাজ শুরু করছে এবং এর মাঝে ৩০টি প্রতিষ্ঠান জাপানের। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৩৪টি জাপানের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
জাপানের বিনিয়োগকারীগণ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল, অটোমোবাইল, এগ্রো ফুড, ফার্মাসিউটিক্যালস প্রভৃতি শিল্পে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। জাপানিজ ইকোনোমিক জোনের ব্যয় ধরা হয়েছে ২,৫৮৫ কোটি টাকা। বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আমলাতাত্রিক জটিলতা দূর করা প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাপানী বিনিয়োগকারীগণের নিকট বড় ধরনের বিনিয়োগ আশা করছেন।
কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে বিনিয়োগের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থান এবং আয়স্তর। সম্পদের সু-সম বন্টনের জন্য বিনিয়োগ জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশ সমূহ বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্যতাদূরীকরণ করতে সক্ষম হয়েছে। জাপান প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত অগ্রসর একটি দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কানেকটিভিটি বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাপানী বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করে জাপানী বিনিয়োগ আনতে সক্ষম হয়েছে এবং জাপানী বিনিয়োগ তাদের আর্থ-সামাজিক আস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনকারী বেকারের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষিত বেকারগণের অবস্থা সত্যই করুণ। মাত্র ২০০ থেকে ৬০০ ডলার প্রদান করলে দেশে পাওয়া যেতে পারে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। তবে এক্ষেত্রে উন্নত প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে জাপানী বিনিয়োগ আনা সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। জাপান হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশে জাপানী বিনিয়োগকারীগণ ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীগণের প্রতি শুভ কামনা রইলো।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।