সুখের সন্ধ্যান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:৪৫:২১ অপরাহ্ন
লুৎফুর চৌধুরী
‘সুখের কথা বল না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন সুখকে। বলেছেন সুখ এক মরিচিকা। সুখের সন্ধানে আজ সবাই দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কিন্তু কয়জন ধরতে পারে সেই সোনার হরিণ? বলা হয়, আগেকার মানুষ সুখী ছিল। গ্রামের নারী-পুরুষ কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে হাতপাখা, ঝুড়ি, চালুনি, কুলা ইত্যাদি শখের জিনিসপত্র তৈরি করতো। নারী-পুরুষ যুবক-যুবতীরা তাদের আপন পরিবেশে বসে বাঁশবেত ও মূর্তা দ্বারা পাটি ও নানা শৌখিন সামগ্রী তৈরি করে অর্থ উপার্জন করতে পারতো। গ্রামের মা-বোনেরা সংসারের কাজ সেরে খাওয়া-দাওয়া শেষে বারান্দায় বসে নিরিবিলি পানের বাটা নিয়ে নানা রকম গল্প-কাহিনি বলতেন ও শুনতেন। মূর্তাবেত দিয়ে নামাজের পাটি, শোবার পাটি, রান্নাঘরে বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য পাটি তৈরি করে, বাকিগুলো বাজারে বিক্রি করতেন, তা দিয়ে আয়ও হত।
অতীত-ঐতিহ্য গ্রামীণ লোকশিল্প আজ বিলুপ্ত পথে। আজ শহুরে জীবন তো বটেই, গ্রামীণ জীবনেও শান্তি নেই, সুখ নেই। কোনোভাবে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকানির্বাহ করে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। কারণ খাস জমি, বনবাদাড় উজাড় হয়ে গেছে। বাঁশ ও মূর্তা আগের মত দেখা যাচ্ছে না। মূর্তা ও ছনখিত্তা উজাড় হয়ে গেছে। যেখানে ছিল বনভূমি, সেখানে গড়ে উঠেছে প্রাসাদ। আজকের দিনে গ্রামের মানুষ পরিবার চালাতে পারছেন না। এমনকি রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারছে না। অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক খাস জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ে, দীনদুঃখী দরিদ্র মানুষের কান্না শোনে হাসে একপ্রকার জীব। নিজেদের মনে করে সুখের রাজা।
আগেকার দিনে বর্ষায় ধান ও পাট উৎপন্ন হতো। বন্যায় পলিমাটি এসে জমিকে উর্বর করতো। বর্ষণের ওপর কৃষিকাজ সম্পূর্ণ নির্ভর ছিল। হাটবাজার-কৃষিক্ষেত-খালবিল-হাওর ও নদীপথে যাতায়াত সুখের ছিল। খালবিল হাওর নদনদীতে প্রচুর মাছ, শালুক, কলমি শাক পাওয়া যেতো। অপরূপ সাজে সজ্জিত ছিল গ্রামবাংলা। বর্ষা মৌসুম ছিল পল্লি অঞ্চলের অর্থনীতির সুদিন। কারণ বর্ষা হলে জমির উর্বরতা বেড়ে যেত। কিন্তু এখন বর্ষা আমাদের আশা ভরসা স্বপ্নসাধ নয়। বর্ষা আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষণে বন্যা সৃষ্টি হয়, একটানা বর্ষণমুখর দিনগুলো মানুষের জীবনে দুঃখের হয়। আজকের দিনে অবিরাম ঝড় বৃষ্টির ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। ফসল নষ্ট হয়, ঘরবাড়ি ভেসে যায়, রাস্তাঘাট ডুবে যায়। অতীতে অবিরাম বৃষ্টিপাত হলেও এতে ক্ষতি হতো না, তখনকার জীবনে খালবিল নদীনালা ডুবা হাওরে গভীরতা ছিল। আমাদের দেশে বেশ পরিচিতি বিবিয়ানা নদী। প্রবীণদের কাছ থেকে শুনেছি এই নদীতে লঞ্চ জাহাজ স্টিমার যাতায়াত করতো। বিবিয়ানা নদীর এপার জগন্নাথপুর উপজেলার শেষ সীমানা, ওপারে নবীগঞ্জ উপজেলার শেষ সীমানা। সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি, এখন এই নদী শুকনো খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে এখন দোকানপাট-রাস্তঘাট। নদীর পেটে এখন রোদে খাঁ খাঁ করে।
এক শ্রেণীর জীব আজ লোভের জালে বন্দী। লোভের ঘ্রাণে অস্থির। তাদের আগ্রাসনে আজ খালের বুকের উপর ছাগলের দঁড়ির মতো বাঁধ। যা ডেকে এনেছে চাষিদের চরম সর্বনাশ। আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি পাটচাষের জমির জন্য বৃষ্টির পানি ও ভেজা মাটির প্রয়োজন। কারণ পলিমাটিতে পাট ভালো জন্মে। এর জন্য নিচু জমিতে পাটচাষের ফলন খুবই ভালো হয়ে থাকে। অতীতের দিনগুলোতে গ্রামের ধনী দরিদ্র সকলের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল এই সোনালী আঁশ। কাঁচা পাটগাছ, সবুজে ঘেরা পাট গাছের ফাঁকে ফাঁকে পানির স্রোতে চিকচিক করতো। শিং মাগুর কৈ ও পুঁটি মাছ ধরার ধুম পড়তো। পাট গাছের ডালপালা থেকে প্রচুর পাটকাঠি হত, এসব বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতেন গ্রামের মানুষেরা। যখনই চারা গজিয়ে উঠতো তা থেকে বড় চারাগুলো রেখে আগাছা বেছে নিতেন শাকসবজি রান্নাবান্নার জন্য। এই পাট দিয়ে দড়ি, থলে, ছালা, ব্যাগসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য তৈরি হতো। পাটখড়ি জ্বালানি কাজে ব্যবহত হত। ঘরের বেড়ায় লাগানো হতো। আষাঢ় শ্রাবণ মাসেই পাট কাটা শুরু হতো, পাটচাষ থেকে কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসতো। কোনো সময় সারাদেশে পাটের কদর ছিল। এমনকি সরকারও পাট থেকে প্রচুর মুদ্রা অর্জন করত।
আগেকার দিনে মাঠে সবুজের সমারোহ দেখা যেতো। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে কৃষক ফসল উৎপাদন করতো। তাদের জীবনে এখনকার মত অভাব অনটন ছিল না। রোগশোকও তেমন ছিল না। ভাতকাপড় ছিল, সারা বছর খেয়েও ঘরে যথেষ্ট খাদ্যশস্য থাকতো। এখন প্রতিবছর কৃষকের জমির ফসল অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখনই হতভাগ্য কৃষক চরম দুঃখকষ্টে দিনপাত করে। আজ কৃষকদের জীবনে ভাগ্যের বিড়ম্বনা। যে খালবিল নদীনালা হাওর ছিল, সরকার মহোদয় এসব আগের মত ফিরিয়ে দিলে অদূর ভবিষ্যতে কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে, তাদের অবস্থার উন্নতি হবে। কৃষক আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কৃষকেরা চাষাবাদ করে, হাঁস মুরগ পশু পালন করে বলে আমরা বেঁচে আছি। সরকার কৃষকদের চাষাবাদের জন্য অধিক হারে ভর্তুকি দিলে, সময়মতো সার ও কীটনাশক পেলে, সহজ শর্তে কৃষিঋণ পেলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে। ফসল ভালো হবে। আমাদের অর্থনীতি উন্নত হবে। জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হবে।
লেখক : কবি।