রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:০০:০৫ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে প্রায় বার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় নেয়। এতে করে পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশকে। এমনি অবস্থায় জাতিসংঘসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের প্রতি সমবেদনা সহ এ সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসেন। আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সচেষ্ট হন। কেউ কেউ জ্ঞাত-অজ্ঞাত কারণে দুঃখজনকভাবে নীরবতা অবলম্বনও করেন। কারো কারো মায়াকান্না চোখে পড়ার মতো। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে তথাকথিত শান্তির দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জীবনাকাশে একটি শান্তির পায়রাও উড়তে দেখা যায় না। আর রোহিঙ্গাদের জীবনে শান্তির বাতাস না বইলে অশান্তির গরম বাতাস কিছুটা হলেও বাংলাদেশকে ভাবিয়ে তুলবে। এর আলামত ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় খুব একটা কিছু ভাবছে বলে মনে হয় না।
আমার মনে হয় এ ব্যাপারে ৩.১.২০২৩ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের একটি খবরের শিরোনামই যথেষ্ট। আর সেটি হলো ‘অপহরণ আতঙ্কে স্থানীয়রা’ ধরা পড়েনি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী চক্র।’ এখানে ‘স্থানীয়রা’ বলতে টেকনাফের উপকূলীয় বাহার ছড়ার এলাকার স্থানীয় লোকজনকেই বুঝানো হচ্ছে।
খবরে বলা, হয় সন্ত্রাসী কিছু রোহিঙ্গার ভয়ে টেকনাফের উপকূলীয় বাহার ছড়ায় অপহরণ আতঙ্ক বিরাজ করছে। মোদ্দা কথা হলো স্থানীয় জনগণ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তারা যেন আজ নিজ ভূতে পরবাসী। দুই সপ্তাহ আগে নাকি স্থানীয় ৮ ব্যক্তিকে অপহরণ করে রোহিঙ্গারা ২৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে। এছাড়া শারীরিক নির্যাতনের আতঙ্কও রয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর বিকালে পাহাড়ি ছড়ায় স্থানীয়রা মাছ ধরতে গেলে অস্ত্রের মুখে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদেরকে অপহরণ করে। জানা যায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সন্ত্রাসীরা ৮ জনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কিন্তু পুলিশ সন্ত্রাসীদের ধরতে পারেনি। এমনি অবস্থায় রোহিঙ্গারা এলাকায় আবারো যে অপহরণ করবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে। এদিকে এতোদিনের মধ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আটক করতে না পারায় জনমনে পুলিশ বাহিনীর কর্মতৎপরতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি মারছে। কেউ কেউ এমনও প্রশ্ন রাখছেন- তাহলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা কি পুলিশের চেয়ে শক্তিশালী? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- এমনি অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ এলাকার স্থানীয় মানুষদের ভবিষ্যৎ দারুণ হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্ব মোড়লরা স্থানীয়দের এমনি অবস্থা নিয়ে বা সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে কোন কথা তো বলেনইনি বরং সব সময় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দোষ খুঁজতেই ব্যস্ত। টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা যে অমানবিক বর্বরতার শিকার তা নিয়ে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এ কেমন মানবিক আচরণ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা অতীব জরুরি।
তবে যে যে উত্তরই দিন না কেন, সব কথার শেষ কথা হলো রোহিঙ্গাদের নিজদেশে ফিরে গেলেই সমস্যার সমাধান মিলবে। মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নেবার বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মানবিক বিষয় নিয়ে ভাবাই জরুরি কোন অবস্থাতেই কূটরাজনীতি বা কূটরাজনীতির খেলা কোন সমাধান এনে দিতে পারবে না। সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার কোন বিকল্প নেই। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সত্যিকার অর্থে আন্তরিক হলে এবং মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক মনোভাব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেই।
এদিকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা রীতিমত উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় (আমাদের সময় ৮.১.২০২৩) প্রতি দিন নাকি গড়ে ৯০ শিশুর জন্ম হচ্ছে। গত ৫ বছরে ১ লাখ ৫৮ হাজার জন্ম নেওয়া শিশুর জন্ম নিবন্ধন করা হয়েছে। অনেকের ধারণা এর প্রকৃত সংখ্যা ২ লাখ। পরিবার পরিকল্পনা উপপরিচালক (কক্সবাজার) জানান পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সেখানে ৩৫টি এনজিও কাজ করছে এবং রোহিঙ্গাদেরকে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে উৎসাহিত করতে সর্বোচ্চ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কি কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে? যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যে হারে জন্ম হার বাড়ছে তাকে জনবিস্ফোরণই বলা যায়। এমনি অবস্থায় জন্মরোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একদিন হারিয়ে যাবে। ঘটবে পরিবেশ বিপর্যয়। এমনিভাবে অব্যাহতভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জন্মহার বৃদ্ধি পেলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। এদিকে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বর্তমানে আশ্রিত জনসংখ্যা ১৪ লাখে দাঁড়িয়েছে। এই জনসংখ্যার বৃদ্ধি আরো বাড়িয়ে তুলছে তাদের মধ্যে বাল্য বিয়ে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি। এ দিকে কক্সবাজারের পরিবার পরিকল্পনা উপপরিচালক বলেছেন, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে উৎসাহিত করতে নাকি সর্বোচ্চ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু ‘উৎসাহিত’ করার ফল কি হচ্ছে তা তো সহজেই অনুমেয়। এই ‘উৎসাহিত’ এর নমুনা হলো এই ক’দিনে এগারো লাখ থেকে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে ১৪ লাখে উন্নতি হওয়া। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আর উৎসাহ প্রদান নয়। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে বাধ্য করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ অতীব জরুরি।
উল্লেখিত বিষয়ে লিখতে গিয়ে একাত্তরে পাক-বাহিনীর হাতে অত্যাচারিত নির্যাতিত বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের কথা খুবই মনে পড়ছে। ইতিহাস বলে- এই এক কোটি ছিন্নমূল মানুষ কখনো ভারতের স্থানীয় জনসাধারণের কাছে আতঙ্ক ছিলেন না। কোন প্রকার অপহরণ আতঙ্কে স্থানীয়রা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন না। বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ভারতের জনগণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ছিলেন। আমরা যারা ভারতের মাটিতে আশ্রিত ছিলাম আমরাও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোন প্রকার কার্পণ্য করিনি। সেখানে ছিলো এক সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ। ভারতের কেউ বলতে পারবেন না যে, বাংলাদেশের কোন শরণার্থী কর্তৃক কোন ভারতীয় অপহৃত হয়েছিলেন। কিন্তু কক্সবাজারের স্থানীয়রা আজ আশ্রিত রোহিঙ্গা দ্বারা অপহরণ আতঙ্কে আতঙ্কিত। বাংলাদেশ-মিয়ানমার তো আছেই, এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকেও এগিয়ে আসতে হবে। নইলে এ ধরনের আতঙ্ক সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, বিশ্বশান্তির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধ।