সিলেটে শেষ হলো তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণে পানি শাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ৩:৩৩:১২ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণে পানি শাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি। এজন্য পানি ও এর ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সকলকে জোর দিতে হবে। নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াকে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, নীতি ও কর্মের রূপান্তর করার জন্য আমাদের এখন সনাক্ত করতে হবে কিভাবে নদী ও প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্যায়ন করা যায়।
একশন এইড বাংলাদেশ এর আয়োজনে ‘জীবন-জীবিকার জন্য পানি এবং নদী ঃ যুবদের ভূমিকা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সিলেটের নাজিমগড় রিসোর্টে আয়োজিত তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের সমাপনী দিনে গতকাল বুধবার ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। গত সোমবার সিলেটে তিনদিনব্যাপী এ সম্মেলনের উদ্বোধন করা হয়। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদী ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা পরিদর্শনের মাধ্যমে সম্মেলনের সূচনা হয়।
৮ম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন সফল করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দন জানিয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী আরো বলেন, “সরকার বিবিএস-এর সহায়তায় প্রাকৃতিক সম্পদের হিসাব করার উদ্যোগ নিয়েছে; যেখানে নদীও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে। এটি দেশের জিডিপিতে প্রতিফলিত হবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্যায়নের উপর বার্ষিক প্রকাশনা থাকবে”, বলে জানান তিনি।
তিনি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত পানিজাদুঘরকে কিভাবে সমৃদ্ধ করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন এবং পানি ও নদী সম্পর্কে মানুষের জানার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার বিষয়েও অভিমত প্রকাশ করেন।
এই সম্মেলন নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সরকার প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে পানি ও নদী সম্পর্কিত সমস্যার ক্ষেত্রে যুব সংহতকরণ এর উপর আলোকপাত করে। সম্মেলনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পানি ও নদীশাসনে অবদান রাখতে পারে এমন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় উঠে আসে।
সম্মেলনটি পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্র- জলাশয় ইতিহাস, রূপবিদ্যা এবং পরিবর্তন; নদী একটি জীবন্ত সত্তা এবং নদীর উপর নৃতাত্ত্বিক হস্তক্ষেপের প্রভাব; পানি ও নদী অধিকারে যুব সম্পৃক্ততা; আন্তঃদেশীয় নদী ও পানি রাজনীতি; উদ্ভাবন, পানি, বাস্তুতন্ত্র ও টেকসই জীবিকাকে আবর্ত করে অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনের প্রথম দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, “মৎস্য আহরণ, কৃষিকাজ এবং শিল্প-সবই পানির উপর নির্ভর করে, যেখানে বাংলাদেশের ৮২০ টিরও বেশি নদী রয়েছে যা আমাদের ভূখ-কে বিশ্বের বৃহত্তম জীবন্ত ব-দ্বীপে পরিণত করেছে।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন বাংলাদেশের সমস্ত নদীকে একই নামের নদীগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য একটি কাঠামো তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে নদীর সঠিক গণনা করা যায় এবং নদীকে সুরক্ষিত রাখা যায়।
একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির তার বক্তব্যে বলেন, “নদীর প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার ওপর ব্যাপকভাবে রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নদীগুলো দখল ও দূষিত হচ্ছে। নদীগুলোর আয়তনও সংকুচিত হচ্ছে দিনদিন। নদীর অস্তিত্ব ও প্রাণ আছে। জোর করে এর গতিপথ পরিবর্তন করা প্রকৃতি এবং মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। নদীগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হতে দিতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, পানি সম্মেলন আমাদের সঠিকপথে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছে, বিশেষ করে সারা দেশ এবং দক্ষিণ-এশিয়া অঞ্চলের মানুষকে পানি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। এই বছর যেহেতু আমরা নদীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তরুণদের সম্পৃক্ত করার গুরুত্বের উপর জোর দিচ্ছি, নীতিনির্ধারকদেরও ভাবতে হবে কীভাবে দেশের ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি নদী ও পরিবেশের সমস্যাসমূহের পক্ষে সমর্থন করার জন্য সংগঠিত করা যায়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এর সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ এর ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, “নদীর অবয়ব নির্ভর করে পানি ও পলল প্রবাহের উপরে। এসবের পরিবর্তন হলে স্বাভাবিকভাবেই নদীর ভৌগলিক পরিবর্তন আসে যার কারণে নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। নদীভাঙনের ফলে মানুষের বসতি ও ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গন রোধে নদীশাসন এর কথা আসে, আর এই নদীশাসন করতে গেলেই নদীর স্বাভাবিক অবস্থা ও প্রবাহগত চরিত্রের পরিবর্তন আসে। তাই এসকল বিষয় বিবেচনা করে টেকসই সমাধানের পথ বের করতে হবে।”
এনভায়রনমেন্ট গভর্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশন (এনজিআইও) এবং ভারতের পরিবেশ ও জলবায়ু সাংবাদিক জয়ন্ত বসু বলেন, আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো যাতে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই উপকার করে-এর একটি উপায় চিহ্নিত করতে হবে।
সম্মেলেনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- এস এম মনজুরুল হান্নান খান, নির্বাহী পরিচালক, নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট; ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ, ভাইস-চেয়ার, একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সোসাইটি; মোঃ জহির বিন আলম, অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; শেখ রোকন সাধারণ সম্পাদক, রিভারাইন পিপল; হাসিন জাহান, কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ; ডাঃ ঝাং জিন, সহযোগী অধ্যাপক এবং ভাইস ডিরেক্টর, সেন্টার ফর আফ্রিকান স্টাডিজ, সাংহাই নরমাল ইউনিভার্সিটি; কলকাতায় অবস্থিত লিভিং ওয়াটারস মিউজিয়াম (এলডব্লিউএম) এর আর্ট অ্যান্ড আউটরিচ কো-অর্ডিনেটর সুকৃত সেন অন্যান্যদের মধ্যে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
সম্মেলনের অগ্রগতির পথ হিসেবে নদীর অধিকার নিশ্চিত করতে তরুণদের আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে বলে জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়াও দেশের প্রতিটি নদীর জন্য একটি যুব প্ল্যাটফর্ম চালু করার প্রস্তাবনা আসে যা নদীরক্ষাকারীদের কার্যক্রমকে নেতৃত্ব দেবে। ছবি এবং জিপিএস ব্যবহার করে একটি নদীর মানচিত্র এর ডাটাবেস স্থাপনে যুবদলকে নিযুক্ত করার প্রস্তাবও আসে সম্মেলন থেকে। সর্বোপরি নদী ও পানি সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণের সম্পৃক্ততা, সচেতনতা, অ্যাডভোকেসি এবং আন্তঃসীমান্ত সংলাপ উন্নত করার পরামর্শ উঠে আসে সম্মেলন থেকে।