ডলার সংকটের সমাধান কী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:২৭:১৭ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ মারুফ হোসেন
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি ক্রান্তিকাল চলছে। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার স্বাভাবিক জোগান নিশ্চিত করার বিষয়টি সকলকে চিন্তিত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে তা সংকট উত্তরণে যথার্থ নয়।
দেশের প্রায় ১ কোটি নাগরিক স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বিদেশে আছেন। যাদের কম-বেশি সবাই সে দেশে কাজ করছেন। গড়ে তারা যে বৈধভাবে প্রেরণযোগ্য ২০০ ডলার প্রতি মাসে আয় করছেন না- তা কি বোধগম্য? মোটেও নয়। সে হিসেবে কেন প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০০/২৫০ কোটি ডলার অর্থাৎ ২.৫ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় বৈধভাবে দেশে আসছে না-তার কি কোনো গবেষণা হয়েছে? হয়ে থাকলে তার আলোকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
নিশ্চিত করে বলা যায়, যদি সব প্রবাসী আয়কারক হুন্ডি চ্যানেলে তাদের অর্জিত অর্থ পাঠানোর নিরাপদ সুযোগ পেতেন তবে কেউ ব্যাংক মারফত টাকা পাঠাতেন না। তার মানে কী দাঁড়াল? মানে দাঁড়াল এই যে সুযোগ না পাওয়ায় কিছু মানুষ ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে। আর ৭০ শতাংশ মানুষ অবৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠাচ্ছে। অর্থাৎ সুযোগ না থাকার কারণে ৩০ শতাংশ মানুষ ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাচ্ছে। আরো সরলভাবে বললে বলা যায়, সুযোগ না থাকার কারণে এখনো কিছু মানুষ সত্ পথে অর্থ প্রেরণ করছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান বেড়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান তা-ই বলে। অথচ ডিসেম্বর মাসে মাত্র ১৬৯.৯৭ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে বৈধ চ্যানেলে। নভেম্বর মাসে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার এসেছে বৈধ চ্যানেলে। অথচ হুন্ডি রোধ করা গেলে (কমপক্ষে ৭০ শতাংশ রোধ করা গেলেও) ২৫০ কোটি ডলার প্রতি মাসে প্রবাসী খাত হতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো বাংলাদেশের। তখন বছরে আয় হতো ৩০ বিলিয়ন ডলার। আমরা সবসময় প্রবাসী শ্রমিক-কর্মচারীদের আয়ের কথা বলি, কিন্তু বাংলাদেশের যে নাগরিকগণ বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন তারা যখন দেশে বেড়াতে আসেন তারা কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ চ্যানেলে পাঠাচ্ছেন বা তারা যখন দেশে আসছেন তখন বিমানবন্দরে কি কোনোরূপ বৈদেশিক মুদ্রা ভাঙাচ্ছেন তা চিন্তা করে দেখেছি আমরা?
বাংলাদেশ ব্যাংক-এর ওয়েবসাইট ভিজিট করলে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রবাসী আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে জনগণকে বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের আহ্বান করেছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে শুধু আহ্বান বা অনুরোধ করার মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আহরণ বাড়বে না। তেমন হলে ধর্মীয় আহ্বান বা নির্দেশ নির্দেশনার মধ্যেই তো সকলের ভালো কাজ করার কথা ছিল। মানুষ তো তাহলে অবৈধ পথে অর্থ পাঠাতেন না। অর্থ যেখানে মুখ্য সেখানে দেশপ্রেম গৌণ। তাই বলব বাংলাদেশ ব্যাংক/সরকারকে আইনের বিধিবিধান কঠোর করতে হবে। বিদ্যমান বিধিবিধানের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। তখনই কেবল বৈদেশিক মুদ্রার আহরণ বাড়বে। কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছাবে বৈদেশিক আয়। তখন রিজার্ভ বাড়বে। কমবে চলতি হিসাবের ঘাটতি। দেশের মুদ্রার মান বাড়বে। আমদানি পণ্যের ব্যয় কমবে। মুদ্রাস্ফীতি কমবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবে এখনকার সংকটজনক পরিস্থিতিতে কী কী করা যেতে পারে তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানে; ১) প্রবাসীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারের সঙ্গে পাসপোর্ট নাম্বারের লিংক সংযুক্ত করে দিতে হবে যেন সরকার নিশ্চিত হতে পারে নির্দিষ্ট ব্যক্তি ব্যাংক চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ করেছেন। ব্যাংকগুলো প্রতি মাসে তাদের নমিনিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ নিশ্চিত করবেন। ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা স্বাভাবিক রাখার জন্য এমন তদারকি করতে পারে; যা তাদের জন্য বেশ সহজ।
২) বিএমইটি ইমিগ্রেশন কার্ডের সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লিংক সংযুক্ত করে দিলে বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ চ্যানেলে প্রেরণের হিসাব সংরক্ষিত থাকতে পারে। প্রবাসীগণ বিদেশে বসে তার কার্ড চেক করে জানতে পারবেন তিনি কতো অর্থ প্রেরণ করেছিলেন এবং প্রেরিত অর্থের এন্ট্রি হয়েছে কি না?
৩) ইউরোপ/আমেরিকার নাগরিকদের বাংলাদেশে ঢুকার ক্ষেত্রে ভিসা প্রথা বাদ দিয়ে প্রতি বিদেশি ১ হাজার ডলার ভাঙাবেন বিমান বন্দরে এবং ভিসা পাবেন। এমন শর্ত দিন। এমন হলে বিদেশিদের আগমন সহজ হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার হবে। পর্যটন ব্যবসারও প্রসার হবে। কর্মসংস্থানও বাড়বে।
৪) এর পরেও হুন্ডি বন্ধে সকল রেডিও টিভিতে বিশেষ প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সব টিভি চ্যানেল নিজস্ব উদ্যোগে প্রচার করবে। এমন নয় যে, মন্ত্রণালয়/বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিজ্ঞাপন বানিয়ে দিল এবং টিভি ও রেডিওগুলো তা তোতা পাখির ন্যায় প্রচার করল।
৫) দেশের নাগরিক হিসেবে প্রবাসে আয় করতে যাচ্ছেন আমাদের নাগরিকগণ। দেশের স্বার্থ দেখতে হবে আগে। বিদেশের দূতাবাসগুলোকে কর্মতৎপর করতে হবে। বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশস্থ দূতাবাসগুলোকে অনুরোধ করতে হবে, তারা যেন তাদের দেশে কর্মরত আমাদের দেশের নাগরিকদের বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ আইনের মধ্যে আনেন। এতে উভয় দেশের ব্যাংকিং খাত সুদৃঢ় হবে।
৬) অন্য দিকে প্রতিটি থানায়, ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে মাইকিং করতে হবে যেন সবার প্রিয়জন বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ করেন। বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ না করলে জবাবদিহি করতে হবে এবং শাস্তি ভোগ করতে হবে সে কথা মাইকে প্রচার করতে হবে।
এ কথা নিশ্চিত করে ধরে নেওয়া যায় বৈধপথে অর্থ আহরণের মাধ্যমেই কেবল বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহজনিত সংকট দূর করা সম্ভব। শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ বা ১০০ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে এলসি করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার ঊর্ধ্বমুখী দাম কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। উপরের প্রস্তাবসমূহ প্রাথমিক ধরে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে উপযুক্ত মহলের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক