সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস প্রসঙ্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:২৯:২৬ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল
সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের প্রাইভেট রোগী দেখার ব্যবস্থা করছে সরকার। সম্প্রতি এ ঘোষণার পর অনেকেই অনেক কথা বলছেন। দেশের স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসা নিয়ে নানান কথাবার্তা সবসময়ই চলমান। অনেকেই বলছেন এক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা, মনিটরিং এবং সেবার ভারসাম্য রক্ষ করতে না পারলে হিতে বিপরীত হওয়ারই শঙ্কা বেশি। তার বলছেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রতি রোগীদের আস্থা বেশি। চিকিৎসকদের দক্ষতা এবং স্বল্প খরচের জন্য সবার প্রথম আগ্রহ সরকারি হাসপাতালেই। আবার তাদের নিয়েই সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রোগীদের। রোগীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতে গিয়ে হাসপাতালে রোগীদের ঠিকমতো সময় দেন না। সরকার দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। সরকার বলছে চিকিৎসকদের এ ধরনের প্রবণতা রুখতে এবার তাদের জন্য সরকারি হাসপাতালেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে তারা। গত ২২ জানুয়ারি রোববার সচিবালয়ে নিজ দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন চিকিৎসকরা সরকারি যে হাসপাতালে চাকরি করছেন, তারা ঐ হাসপাতালেই ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখতে পারবেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি জানান, আগামী ১ মার্চ থেকে পাইলট কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ কার্যক্রম শুরু হবে। রোববার সচিবালয়ে নিজ দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), নেতা এবং মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী বলেন, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস কার্যক্রম শুরু হলে রোগীরা বেশি চিকিৎসাসেবা পাবেন। চিকিৎসকদের এ বিষয়ে আরো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা করার বেশি সুযোগ পাবেন বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, হাসপাতালে প্র্যাকটিসের পর যদি চিকিৎসকরা কেউ চান, বাইরেও প্র্যাকটিস করতে পারবেন। ১ মার্চ থেকে ৫০টি উপজেলা, ২০টি জেলা এবং পাঁচটি মেডিকেল কলেজে শুরু হবে।
এক্ষেত্রে অনেকে একই হাসপাতালে সরকারি এবং প্রাইভেট দুই রকমের চিকিৎসা সেবা হয়ে গেল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন যারা সরকারি ফিতে ডাক্তার দেখাবেন তারা পাবেন এক রকম চিকিৎসা এবং যারা প্রাইভেটে দেখাবেন তারা পাবেন ভিন্ন রকম। এক হাসপাতালে দুই রকমের চিকিৎসার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এতে সেবার মানে যেন কোনো তারতম্য তৈরি না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
তবে সরকার বলছে, বর্তমানে চলমান চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার কাজ যেভাবে চলছে তা কোনোক্রমেই বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে প্রথমে কেবল সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করা এবং এ অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তী সময়ে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে তা চালু করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বৈকালিক রোস্টার চালু করা, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের আয়-ব্যয়ের ক্ষমতা স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর দেওয়া, বহির্বিভাগে রোগী দেখা ও বসার স্থানের আধুনিকায়ন, নার্সসহ প্রয়োজনীয় সহায়ক লোকবলের উৎসাহ ভাতার ব্যবস্থা ও রোগীদের রোগ নিরীক্ষণের প্রতিবেদন দ্রুততম সময়ে দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। রোগী ভর্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, বৈকালিক রোগীদের ভর্তির জন্য পৃথক বিছানা, অপারেশন থিয়েটার চালু থাকতে হবে। এ প্র্যাকটিসের মাধ্যমে আয়ের ১০ শতাংশ আয়কর প্রদান সাপেক্ষে ৬০ শতাংশ চিকিৎসক ও বাকি ৪০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসা সহায়তাকারীদের মধ্যে বিতরণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
অনেকে মনে করেন সরকারি হাসপাতালে যদি ডাক্তারদের ফি ধার্য করে বৈকালিক আউডডোর সেবা চালু করা হয়, তবে তা নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখন দালালের দৌরাত্ম্য আরো বাড়বে। আর সকালের চেয়ে বিকালে রোগীর ভিড় বেশি হবে।
ফলে সকালে ডাক্তাররা আউটডোরে বসতে নিরুৎসাহিত হবেন। অন্যদিকে যদি সকালের আউটডোর টাইমকেই বর্ধিত করে বিকাল ৪টা-৫টা পর্যন্ত করা হয়, তা-ও সমস্যা তৈরি করবে চাকরিবিধি অনুসারে। সরকারি চাকরিজীবীরা সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পান, চিকিৎসকরা ছুটি পান একদিন। এ কারণে হাসপাতালে সেবা সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা করা হয়েছে। অন্যদিকে জনবল সংকট প্রকট। বিদ্যমান জনবল দিয়ে দুই শিফটে সেবা দেওয়া সম্ভব কিনা, তাও এক প্রশ্ন। এসব কারণে সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক সেবার পরিকল্পনা কার্যকর করা যায়নি। নতুন এ পরিকল্পনা কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা দেখার বিষয়। এতে রোগীর সেবার মান কমে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন এখনই এ ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাদের একটি ইচ্ছার কথা এখানে ব্যক্ত করেছেন। মন্ত্রী যে বিষয়টি বলেছেন তা খুব সুন্দর। সাধারণ মানুষ যদি কম পয়সায় সরকারি হাসপাতালে বড়ো বড়ো ডাক্তারদের থেকে আলাদা সেবা পায় তা ভালো। কিন্তু এটা করতে হলে সুনির্দিষ্ট এবং সুনিপুণ পরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে। নইলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামতের ভিত্তিতেই তা করা সুন্দর হবে।
পরিশেষে বলতে চাই সরকারি হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসকদের থেকে প্রাইভেট সেবা নেওয়ার এই বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এ নিয়ে নানান কথা আছে তবে তা যদি খোলাসা করা যায় এবং দুর্নীতির পথ রুদ্ধ করা যায় তবে এটা রোগীদের জন্যই ভালো হবে।
লেখক : সাংবাদিক