শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৪৫:২৮ অপরাহ্ন
মো. লোকমান হেকিম
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতিও রক্ষা করতে পারছে না মানুষ নামের প্রাণী ও তার আবাসভূমিকে ধ্বংস, ক্ষয় আর চরম নির্মমতার হাত থেকে। আমরা প্রতিনিয়ত পৈশাচিক আর হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। সমাজ অভ্যন্তরে চলছে গভীর সঙ্কট। নীতি আদর্শ এবং মূল্যবোধ হারিয়ে মানুষ হয়ে উঠেছে জাহেলিয়া যুগের পশুবৃত্তি ও জিঘাংসাপ্রবন। খুন, গুম, অনৈতিক কর্মকাণ্ড মানবতাকে পদদলিত করে চলেছে। বিশেষ করে শিশুর প্রতি নৃশংসতা ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। আগামীর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কেমন হবে আজকের আমাদের চর্চিত জীবনের ওপর তা নির্ভর করছে। প্রতি মুহূর্ত আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে চলেছি।
আজকের একটি শুভ কাজের চর্চার বিকশিত ফল আমরা আগামীতে ভোগ করব। একইভাবে একটি মন্দ কর্ম চর্চার বিষফলও ভবিষ্যতে আমাদের আস্বাদন করতে হবে। কথাগুলো আমরা বলছি শিশুদের প্রসঙ্গে। আজকের শিশুরা আমাদের আগামী দিনের কাণ্ডারি। তাই দেশে শিশু অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না হওয়ায় পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছে তারা। এর মাত্রা দিন দিনই বাড়ছে। শিশুরা দুর্বল। প্রতিরোধক্ষমতা না থাকায় তাদের ওপর নানামাত্রিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ইদানীং শিশুহত্যার মত নৃশংস ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। নিকট অতীতেও আমাদের দেশে জন্মের সময় বিপুল সংখ্যক নবজাতক মারা যেত। সন্তান জন্মদানের সময় প্রসূতির মৃত্যুর হারও ছিল উচ্চমাত্রায়। আগের সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সামাজিক নিষ্ঠুরতায় শিশুমৃত্যু বাড়ছে। এটি উদ্বেগের। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বেসরকারি সংস্থার ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ (এমজেএফ) গত ২৪-০১-২০২৩ মঙ্গলবার প্রকাশিত শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন-২০২২-এর তথ্যে। প্রতিবেদন অনুসারে, এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সেগুলো হলো- যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্যান্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪২৬টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৯৪, অর্থাৎ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
সারা দেশে শিশু অধিকার পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে; তা বোঝা যায় দেশের সংবাদপত্রগুলোয় ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শিশুহত্যার খবর প্রায় তিনগুণ বেশি প্রকাশিত হওয়ায়। ২০২১ সালে ১৮৩টি শিশু হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৭টিতে। বিদায়ী বছরে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি- এক হাজার ৪১৯টি। যা ২০২১ সালের তুলনায় তিনগুণের বেশি। এ ছাড়া গেল এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শিশু নিয়ে সংবাদ প্রকাশও বেড়েছে প্রায় তিনগুণ- ১৯৬টি।
দেশের আটটি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত শিশুবিষয়ক খবর সঙ্কলিত করে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। আমাদের এ কথা মানতেই হবে, সংস্থাটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেশে শিশু অধিকার পরিস্থিতির সাম্প্রতিক প্রবণতা তুলে ধরেছে। এটি যে সারা দেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতির পরিপূর্ণ চিত্র নয়; তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কথা বলার কারণ, চারপাশে শিশুদের ওপর সংঘটিত বহু ঘটনার খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় না। বিদায়ী বছরে ৫৬০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আগের বছর ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ কম। ২০২২ সালে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ৯৮ শিশু, যা আগের তুলনায় কিছুটা বেশি। আমাদের মনে রাখা দরকার, যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে একটি শিশুর ডানা ভেঙে দেয়া হয়। ওই শিশু আর বিকশিত হতে পারে না। ২০২২ সালে ৯৬টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনার বাইরে ৩১১টি শিশু অন্যান্য দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। গত বছর ৩০ শিশু অপহরণ, ৬৮ শিশু নির্যাতন, ৩৩ শিশু নিখোঁজ ও ৯টি শিশুর বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্ট হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ সময়ে ৪৪টি শিশুর আত্মহত্যা করার খবর এসেছে সংবাদপত্রগুলোতে। দেশে এখনো শিশুধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে।
শিশুরা তাদের ওপর অনাকাক্সিক্ষত নির্যাতন প্রতিহত করতে অক্ষম, উপরন্তু ভয়ে ঘটনা গোপন করে। ফলে তারা প্রতিবেশী ও স্বজনদের মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমরা মনে করি, দেশে সার্বিক শিশু অধিকারের উন্নতি চাইলে তাদের ব্যাপারে সবার অধিকতর মনোযোগী হওয়া দরকার। বিশেষ করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরো সচেতন হতে হবে। তবে সন্তানের বিষয়ে মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। শিশুদের অভিভাবকরা যাতে অধিকতর সচেতন হতে পারে, সে ব্যাপারে গণমাধ্যমকে ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত কিছু না করলে সামনে সমুহ বিপদ।
লেখক : শিক্ষক।