উপলব্ধি ও জীবনের সুতো
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ৮:৪৩:০৪ অপরাহ্ন

রফিকুর রহমান লজু
লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বহুদিন থেকে চিনি, জানি। তাকে চিনি-জানি মানে তার লেখালেখির সাথে পরিচয় আছে। তিনি উচ্চ শিক্ষিত, পেশায় ডাক্তার। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানি না, জানার প্রয়োজনও নেই। তবুও তার লেখালেখি, লেখার ধরন, লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা না করেও বলা যায় যে, তার লেখার মধ্যে সাহিত্য আছে, সৌন্দর্য আছে, সরলতা আছে। তসলিমা নাসরিন যে বিষয় নিয়ে লেখেন, যেভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে অকপটে লেখেন, তা সভ্যসমাজে স্থান পাওয়ার নয়। মনে হয় তিনি সারা দুনিয়ায় অন্য কোন বিষয়বস্তু দেখতে পান না। যেন আর কোন বিষয় নেই। তিনি ডাক্তার, অন্তত: এই বিষয় নিয়ে তিনি সারাজীবন লিখতে পারেন।
তসলিমা নাসরিনের লেখার প্রধান বিষয় হল সেক্স (ঝবী)। তিনি দৈনিক প্রতিদিনে নিয়মিত লেখেন। আমি ‘প্রতিদিন’ পড়ি। তাই দেখতে পাই তার লেখা। তার লেখার জন্য হয়তো প্রতিদিনের কাটতি কিছু বেশি হয়। অবশ্য দৈনিক প্রতিদিনের সম্মানিত সম্পাদক নঈম নিজাম বিভিন্ন বিষয়ে একটি কলাম লিখে থাকেন। তাঁর কলাম খুবই সমৃদ্ধ। দেশি-বিদেশী, আন্তর্জাতিক বিষয়াদি, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সম্পর্কিত তার কলাম সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে তিনি একটি চমৎকার কলাম লিখেছেন। অন্যান্য কলামগুলিও আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকি। সম্পাদকীয় পাতার সর্ব ডানের কলামটি ধর্মীয় বিষয়ের একটি কলাম। প্রতিদিন এই ধর্মীয় কলামটি প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধের আসল বিষয়টি তসলিমা নাসরিন। আলোচনায় বিভিন্ন প্রসঙ্গ এসে পড়ায় আসল বিষয়টি পিছনে পড়ে যায়।
বলছিলাম যে, তসলিমা নাসরিনের লেখার মূল বিষয় সেক্স। তসলিমার লেখায় কোনদিনই অন্য কোন বিষয় নিয়ে লেখার আগ্রহ কি জাগে না? এই জিজ্ঞাসা থেকে আমি ‘প্রতিদিন’ পড়তাম এবং খোঁজ রাখতাম তসলিমা হয়তো একদিন ঝবী ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে লিখবেন। আর সত্যি সত্যি একদিন পেয়ে গেলাম তসলিমা নাসরিন অন্য বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
গত ১০ নভেম্বর, ২০২২ বৃহস্পতিবার দৈনিক প্রতিদিনের খোলা কলাম পাতায় তসলিমা যে লেখাটি দিয়েছেন, তার শিরোনাম করেছেন ‘সুতোর ওপর হাঁটছি’। ঝবী নয় সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়, ভিন্ন আমেজ। ‘সুতোর ওপর হাঁটছি’ থেকে তুলে ধরছি, তসলিমা নাসরিন লিখেছেন: আমাদের চারদিকে বিপদ। আমাদের পায়ে পায়ে মৃত্যু। রাস্তায় বেরোলে গাড়ি চাপা পড়তে পারি, ঝোপঝাড়ে গেলে সাপের কামড় খেতে পারি, নৌকা চড়লে ডুবে যেতে পারি, বাসে ট্রেনে বা উড়োজাহাজে কোথাও গেলে দুর্ঘটনায় পড়ে জীবন যেতে পারে। তারপরও আমরা জীবন যাপন করছি, রাস্তায় বেরোচ্ছি যানবাহনে চড়ছি। তাছাড়া প্রতিদিনই ‘খাবার খাচ্ছি, পানীয় পান করছি, জেনেই করছি যে, আমরা যা খাচ্ছি, যা পান করছি, তার অনেক কিছুর মধ্যেই বিষ।
তসলিমা আরও লিখেছেন, অনেকেই আমরা অল্প স্বল্প বিষ খেয়েও বেঁচে আছি। সর্ষের তেল খেলে ক্যান্সার হতে পারে, স্যাকারিন খেলে হতে পারে, নোনা মাছ খেলে হতে পার, এরকম হাজারও খাদ্য, যা খেলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই বলে কি ওসব খাবার আমরা একেবারেই মুখে তুলি না? তুলি, কারণ ওই একই। রাস্তায় বেরোলে গাড়ি চাপা পড়ার আশঙ্কা আছে জেনে আমরা রাস্তায় বেরোই এবং এও জানি যে, সকলেই গাড়ি চাপা পড়ি না, কিছু লোক পড়ে। ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা আছে এমন খাবার খেলেও সকলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হই না, কিছু লোক হয়।
বড় স্বল্প, বড় অল্প, বড় চোখের পলকে চলে যাওয়া জীবন আমাদের। এই জীবনকে দীর্ঘ করতে তারপরও আমরা অনেকেই যে যার মতো করে চেষ্টা করি।
সব সময় সফল হই না। সুতো থেকে পা পিছলে পড়ে যাই। কিন্তু পা পিছলে যাবে বলে আমরা হাল ছেড়ে দিই না। বুদ্ধি কিছুটা থাকলেই মানুষ বুঝতে পারে যে, জীবন এক বারই আসে, যে জীবন যায়, সে জীবন চিরদিনের জন্যই যায়।
তসলিমা নাসরিন তার চলমান জীবনকে ‘সুতোর ওপর হাঁটছি’- বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ সুতো যে কোন সময় ছিঁড়ে যেতে পারে, জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। তার এই উপলব্ধি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে, অনেকটা এগিয়ে দিতে পারে সত্যের পথে। জীবনে যৌবনকালে, পুরোপুরি সুস্থ থাকাকালে সুখ ও আনন্দ আগলে রাখে মানুষকে। এর মধ্যেও যারা বিদায়ের কথা ভাবে, মৃত্যুর চিন্তা করে, তারা অসাধারণ, তারা ব্যতিক্রম। তসলিমা নাসরিন এই ব্যতিক্রমদের অর্ন্তভূক্ত হবেন একদিন। তার জীবনে এই ‘একদিন’ শীঘ্রই আসুক, জলদি আসুক।
জানি না, আমার এই লেখা তসলিমা নাসরিনের চোখে পড়বে কিনা। পড়লে, তার কি প্রতিক্রিয়া হয়, তা জানার আগ্রহ নিয়ে এই লেখার ইতি টানলাম।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, কলামিস্ট।