সিলেটের বিচারঙ্গনের ইতিকথা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মার্চ ২০২৩, ৭:৪৮:২৮ অপরাহ্ন
সৈয়দ কাওছার আহমদ
সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণ কাহিনীতে সিলেট জেলা সর্ম্পকে লিখেছেন তা থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে দশম শতাব্দীতে তিনি সিলেট বিজয় করেছিলেন। ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (র:) সিলেট বিজয় করেন। মুসলিম পরিব্রাজক আল বিরুনী তাঁর ‘কিতাবুল হিন্দ’ গ্রন্থে সিলেটকে সিলহট নামে উল্লেখ করেছেন। সুলতানী আমলে সিলেটের নাম ছিল জালালাবাদ। ঐতিহাসিকদের মতে সিলেট বা শ্রীহট্র বহু আগ থেকেই একটি বর্ধিঞ্চু বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
সিলেট জেলার আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লর্ড উইলিয়াম ম্যাগপেস থ্যাকার কে সিলেট জেলার প্রথম কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি একই বছর ১৭ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট লিন্ডসে কালেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সিলেট কে আসামের সাথে সংযুক্ত করেন। তখন সুরমা ভ্যালী ও আসাম ভ্যালী নামে দুটি পৃথক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেন। গণভোটের মাধ্যমে দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে সিলেট তৎকালীন পূর্ববাংলার অর্ন্তভুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে সিলেট জেলা কে ০৪টি জেলায় ভাগ করা হয় যথাক্রমে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট। আবার ১৯৯৫ সালে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলাকে নিয়ে সিলেট বিভাগ গঠন করা হয়।
ইংরেজ শাসন আমলে কালেকক্টর ছিলেন জেলার শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগসহ অন্যান্য সকল বিভাগের একক অধিপতি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর সিলেট অঞ্চলে মোগল আমলে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করেন, দেওয়ানি বিচার ও ফৌজদারি বিচার, দেওয়ান বা তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে দেওয়ানি বিচার এবং ফৌজদার বা তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে ফৌজদারি বিচার পরিচালনা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
কালের বিবর্তনে দেওয়ানি মামলা বিচারের নিমিত্ত Regulation III of 1793 মোতাবেক Courts of Dewanny Adawlut প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই আইনে আর্থিক এখতিয়ার নির্ধারণ করা হয় এক শ্রেণির বিচারকের জন্যে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ রুপি, আরেক শ্রেণির বিচারকের জন্যে সর্বোচ্চ দুইশত রুপি। এরপর প্রত্যেক জেলায় Bengal Sessions Courts Acts 1871 অনুসারে দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ পদের সৃষ্টি করা হয়। তছাড়াও Act XII of 1887 এর ক্ষমতা বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধীনে প্রত্যেক জেলায় District Judge, Subordinate Judge I Munseff নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়। বৃটিশ শাসন প্রত্যক্ষভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে এই অঞ্চলের ভাবধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বৃটিশ কমন ‘ল’ আরোপ করার পর তখন থেকেই আইন পেশার সূচনা হয়। আর তখন থেকেই আইন পেশায় যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের কে যোগ্যতা অনুসারে Pleader, Uokil, Advocate I Mukter বলে অবহিত করা হত।
১৮৭৯ সালে লিগ্যাল প্র্যকটিশনার্স এ্যাক্ট-১৮৭৯ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে আইন পেশার বিধিবদ্ধ নিয়ম অর্থাৎ আইন পেশার অনুমতি প্রদান, অনুমতি বাতিল, শৃঙ্খলা, শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। এই আইন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন সংযোজন, সংশোধন করা হয়। ১৯৬৫ সালে বার কাউন্সিল এ্যাক্ট-১৯৬৫, প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৭২ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ৪৬ নম্বর আদেশে বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যকটিশনার্স এবং বার কাউন্সিল অর্ডার-১৯৭২ প্রণীত হয় এবং এই আইন দ্বারা আইনজীবীদের সনদ প্রদান, সনদ বাতিলসহ আইন পেশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আইান পেশার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বার কাউন্সিল গঠনের জন্যে সারাদেশের বার সমিতির সদস্যদের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ নির্বাচনে ০৭ (সাত) জন সাধারণ সদস্য এবং ০৭ (সাত) জন সদস্য গ্রুফ ভিত্তিক নির্বাচিত হন। এই নির্বাচন ০৩ (তিন) বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বার কাউন্সিলের একজন সভাপতি ও একজন সহ-সভাপতি থাকেন। বাংলাদেশের অ্যাটর্ণী জেনারেল পদাধিকার বলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর সভাপতি এবং নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে সহভাপতি নিযুক্ত হন। শর্তসাপেক্ষে বিভাগীয় বিচারকগণ বা অতিরিক্ত বিভাগীয় বিচারকগণ হতে সরকার কর্তৃক একজন সচিব নিযুক্ত হয়ে থাকেন।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে ”ডি”(কুমিল্লা-সিলেট) অঞ্চলের প্রতিনিধি হয়েছেন, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যগণ তাঁরা হচ্ছেন এডভোকেট তবারক হোসেইন-নির্বাচিত (১৯৯৮-২০০৪), এডভোকেট মোঃ মিছবাহ উদ্দিন সিরাজ-নির্বাচিত (২০০১-২০০৭), এডভোকেট আব্দুল হাই খান-মনোনিত (২০০৭-২০০৮), এডভোকেট দেওয়ান গোলাম রব্বানী চৌধুরী-মনোনিত (২০০৮-২০০৯), এডভোকেট মিছবাহ উদ্দিন সিরাজ-নির্বাচিত (২০০৯-২০১২), এডভোকেট এ.এফ.এম.রুহুল আনাম চৌধুরী মিন্টু-নির্বাচিত (২০১৮-২০২৫)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের কথা বলা থাকায়, রীট পিটিশন নম্বর-২৪২৪/১৯৯৫ মাজদার হোসেন বনাম সরকার মামলায় হাইকোট বিভাগ বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করার পক্ষে রায় প্রদান করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন যার নম্বর হচ্ছে আপিল-৭৯/১৯৯৯। বিগত ০২ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ ১২ দফা দিক নির্দেশনাসহ বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০১ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের উদ্দেশ্যে বিধি ও অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেন। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ০১ নভেম্বর ২০০৭ সালে পদ্ধতিগত আইন এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আইন সংশোধন করে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয়েছে। তদনুযায়ী জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনসহ বেশকিছু সংস্কার সাধিত হয়েছে। জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ কার্যক্রম শূরু হয়েছে। বর্তমানে সিলেট জেলার বিচার বিভাগে ০১ টি জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ০৪ টি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ০৪টি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত, একই পদমর্যাদার ০১ টি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, ১২ টি সিনিয়র সহকারী/সহকারী জজ/পারিবারিক জজ আদালত রয়েছে। জেলা জজ পদমর্যাদায় ০১ টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, ০১টি নিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল, ০১ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এবং ০১ টি বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত চালু আছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হবার পর সিলেটে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ০১টি অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ০৫ টি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও ০৫ টি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মামলা পরিচালনার জন্যে ০১ টি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (বিদ্যুৎ) আদালত স্থাপিত হয়। ২০১৩ সালে ০১টি মহানগর দায়রা জজ আদালত, ০১টি অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত, ০২টি যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত, ০১টি চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ০১টি অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং ০৩টি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত স্থাপনের মধ্য দিয়ে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং চীফ মেট্রাপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদলতের কাজ শুরু হয়েছে।
বর্তমানে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের অধীন ০১ টি অতিরিক্ত কমিশনার আদালত এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধীন ০১টি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ০১টি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আদালত, ০২ টি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ০১ টি জেনারেল সার্টিফিকেট আদালত এবং ভ্রাম্যমান আদালত চালু আছে। সিলেট জেলার ১০৫টি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত চালু রয়েছে।
কিছু দিন হল সিলেট বিভাগের শাহজালাল উপশহরের বি ব্লকের পৃথক দুটি ভাড়া বাড়ীতে শ্রম অধিদপ্তর এবং শ্রম আদালতের কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, খুলনা, বরিশালে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থাকলেও সিলেট বিভাগে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়নি, এখানে একটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল করা ন্যায় বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন। এই বিভাগের আইনজীবীরা দীর্ঘদিন যাবৎ সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সিলেটে হাইকোর্টের আসন স্থাপনের জন্যে দাবী জানিয়ে আসছেন যা বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবী।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট।