ডাণ্ডাবেড়ি অবস্থায় মার জানাজায়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মার্চ ২০২৩, ৭:৫৪:১৫ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। এটা অনুচিত এবং মানবতার অপমান। কারাগারে বন্দি আসামীদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর নিয়ম থাকলেও সবক্ষেত্রে তা ঠিক নয়। দেখা গেছে দায়িত্বপ্রাপ্তরা অতি উৎসাহী হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে কার্যকরী করেন। এ যেনো ধরে আন বললে বেঁধে আনার মতো। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় একজন আসামীর মা মারা যান। তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বিএনপি নেতা মো. আলী আজম। মার জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য তাকে প্যারোলে সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু জানাজার নামাজে তাকে হাজির করা হয় ওই ডাণ্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায়। তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও ডাণ্ডাবেড়ি অবস্থায় তিনি মা’র জানাজায় শরিক হন। এ থেকে এমন অমানবিক আচরণ আর কি হতে পারে।
উল্লেখ্য, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রাত্রিমোড় এলাকায় মাসাধিককাল আগে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা এক মামলায় ২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয় বিএনপি নেতা আলী আজমকে। তিনি উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি। তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ের বিএনপি নেতা হলেও দেশের প্রধান বিরোধীদলের এক ইউনিয়নের নেতা। এই সম্মানটুকু তিনি পেতেই পারেন। এটা কোনো অনুকম্পা নয়, দয়া নয়। এটা মানবাধিকার।
ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজায় নেওয়া সংবিধান পরিপন্থি এবং অমানবিক। এরকম মন্তব্য করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আলী আজমের মা সাহেরা বেগম বার্ধক্যজনিত কারণে গত ১৮ ডিসেম্বর মারা যান। শেষবারের মতো মায়ের মরদেহ দেখতে এবং জানাজায় অংশ নিতে গত ২০ ডিসেম্বর তিন ঘণ্টার জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। প্যারোলে পুরোটা সময় হাতকড়া এবং ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় ছিলেন আলী আজম। এমনকি আলী আজমের মার জানাজার নামাজ পড়বার সময়ও ডাণ্ডাবেড়ি নিয়ে জানাজায় দাঁড়াতে হয়। আলী আজম ডাণ্ডাবেড়ি নিয়েই মার জানাজার নামাজ আদায় করেছেন। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ মতে, বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো বিষয়ক উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা রয়েছে সেটাও এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি। নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে অতিরিক্ত নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েনসহ যথাযথ নজরদারির অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া সমীচীন ছিল। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও ভবিষ্যতে এধরনের কাজে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণে যত্নবান হতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে কমিশন।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আইনের শাসন থাকলে, ঠিকমতো নির্দেশনা দেওয়া থাকলে এমন পরিস্থিতি হতো না। তাদের ছাড় দিতে দিতে এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে, তারা মানুষের সঙ্গে যেমন খুশি তেমন আচরণ করছে। এটা প্রত্যাশিত নয়। এতে সরকারেরও ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।
ডাণ্ডাবেড়ি পরানোতে জেলকোডের ব্যত্যয় ঘটেনি- কারা কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের প্রশ্ন, আইনকে কি শুধু আক্ষরিক অর্থে বিবেচনা করা হবে? মনে রাখতে হবে আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয়। আমাদের সমাজের রীতিনীতি, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আইন প্রয়োগ করা হয়। একজন মানুষ যখন তার মায়ের জানাজায় যাচ্ছে, শেষ দেখা দেখতে যাচ্ছে মাকে, মাকে সমাহিত করতে যাচ্ছে, তখন তাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা কোনো সভ্য সমাজ বা ব্যক্তি সমর্থন করে না। কোনো সভ্য দেশে এমন আইন এখন আর চলে না। ২০০ বছর আগে যে আইন হয়েছে, আজও সেভাবেই থাকবে, পরিবর্তন হবে না, এটা তো কাম্য নয়।
এবার দেখা যাক, ডাণ্ডাবেড়িতে জানাজা কতোটা যৌক্তিক ও বিবেকসম্পন্ন, এ ব্যাপারে সমাজের বিশিষ্টজনদের মতামত কি?
এটা বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ডাণ্ডাবেড়ি পড়িয়ে একজনকে মায়ের জানাজায় নিয়ে যাওয়া বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়। এটা শুধু নিন্দা জানিয়ে বা সমালোচনা করে দায় শেষ করা যাবে না। যে এই কাজটা করেছে, তাকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।
তদন্ত হওয়া প্রয়োজন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেছেন, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ডাণ্ডাবেড়ি না পরিয়ে আদালতে নেওয়ায় তাদের পালিয়ে যেতে দেখলাম। অন্যদিকে একজন রাজনৈতিক আসামীকে মায়ের জানাজা পড়ার সময় ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হলো। এটা কোনোভাবেই একটা আধুনিক রাষ্ট্রের আইনি কর্ম হতে পারে না। সুস্থ মানুষ এমনটি করতে পারে না, এমন আচরণ নিয়ে দায়িত্ব পালন করা যায় না। তিনি বলেছেন, বিষয়টি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আইনের শাসনের জন্যই তা গুরুত্ববাহী।
লেখক : সাবেক শিক্ষক ও সিনিয়র কলামিস্ট।