ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মানী প্রসঙ্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মার্চ ২০২৩, ৯:১০:১৬ অপরাহ্ন

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
আমরা যারা ঈমান এনেছি বিশ^ জগতের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি এবং হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে আল্লাহর শেষ এবং শ্রেষ্ঠ রাসূল হিসেবে মেনে নিয়েছি, তাদের জন্য একাগ্রচিত্তে এবং একনিষ্ঠভাবে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র অংশ। একমাত্র মহাপবিত্র সত্তা আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের পরিশুদ্ধতার জন্য চেষ্টা ও সাধনা একান্ত জরুরি হিসেবে মনে করি যদিও সৃষ্টি হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মুসলিমদের জীবনে মসজিদ অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং মানব আত্মার সংশোধন এবং উন্নতির জন্য একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত অপরিহার্য।
মুসলমানদের জীবনে মসজিদে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নামাজ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য হবার জন্য পরিশুদ্ধতা ও একাগ্রতা প্রয়োজন। সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মধ্যে যে ইবাদতের সংযোগ ঘটে সেটা হয়ে থাকে মসজিদের ইমামগণের মাধ্যমে। একজন জ্ঞানী ইমাম সাহেব ইবাদতের পরিশুদ্ধতার কারণ হতে পারেন এবং আত্মার সংশোধনের জন্য এবং চারিত্রিক উন্নয়ন তথা চরিত্র গঠনের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। আত্মা পবিত্র ও অশ্লীলতা মুক্ত না হলে সেই ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন দুরূহ ব্যাপার এবং মসজিদের ইমামগণ মানবসমাজকে পবিত্র জীবন-যাপনের মাধ্যমে পরকালীন মুক্তির পথ দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু দুঃখের সাথে খেয়াল করলে দেখা যায়, ইমাম সাহেব এবং মুয়াজ্জিন সাহেবগণের বেতন অথবা সম্মানী প্রয়োজনের তুলনায় অনেকাংশে কম।
লক্ষ্য করে দেখা যায়, সিলেট শহরের মোটামুটি বড় পরিসরের মসজিদগুলোতে সম্মানিত ইমাম সাহেবগণ সম্মানী অথবা বেতন হিসেবে পাচ্ছেন ১০ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা মাত্র। মুয়াজ্জিন সাহেবগণের বেতন অথবা সম্মানী ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা মাত্র। গ্রামাঞ্চলের অনেক মসজিদগুলোতে ইমাম সাহেবগণ পাচ্ছেন ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা মাত্র আর মোয়াজ্জিনগণ পাচ্ছেন ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা মাত্র। সুনামগঞ্জের অনেক জায়গায় কাও-মী মাদ্রাসার শিক্ষকগণ পাচ্ছেন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা মাত্র। অনেকে হাদিয়া স্বরূপ সামান্য কিছু পেয়ে থাকেন। সিলেট শহরের একটি মসজিদে যোহরের নামাজ আদায়ের পর কথা হলো একজন মোয়াজ্জিন সাহেবের সাথে। মোয়াজ্জিন সাহেবের স্ত্রীসহ কয়েকজন সন্তান রয়েছে। থাকার জন্য দেয়া হয়েছে একটি মাত্র রুম আর সাথে বেতন বা সম্মানী মাত্র ৩ হাজার টাকা। মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর এবং বড় আকারের এবং মসজিদের নির্মাণে মার্বেল পাথরসহ সৌন্দর্য্যবর্ধনে দামী উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এত বড় মসজিদ অথচ মোয়াজ্জিন সাহেবের বেতন ৩ হাজার!। মুয়াজ্জিন সাহেব দুঃখ করে জানালেন, মসজিদ পরিচালনাকারী একজন ধনী ব্যক্তিকে বিষয়টি জানালে তিনি উত্তর দিলেন এর চেয়ে বেশি দেওয়া সম্ভব নয়।
কথা হলো, সিলেট শহরের ধনী জনগনের এলাকা নামে পরিচিত একটি এলাকার দ্বিতীয় ইমাম সাহেবের সাথে। তিনি জানালেন, প্রায় ১৮ বছর ধরে মসজিদের সাথে আছেন। বর্তমানে বেতন বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ২ শত টাকা। সিলেট শহরের শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্তের এলাকায় অবস্থিত আরও একটি মসজিদের একজন সম্মানিত ইমাম সাহেবের সাথেও কথা হলো। দীর্ঘ ১৮ বছর মসজিদের ইমামতি করে কিছুদিন পূর্বেও সম্মানী বা বেতন হিসেবে পেয়েছেন মাত্র ১৩ হাজার টাকা! বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইমাম সাহেব অথবা মুয়াজ্জিন সাহেবগণের স্ত্রী ও সন্তানদের নিজের কাছে রাখার মত সামর্থ থাকে না। সৃষ্টি এবং মহান সৃষ্টিকর্তার মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের এবং ইবাদতের মাধ্যম হচ্ছেন ইমাম সাহেবগণ। সামাজিক উন্নয়ন এবং চারিত্রিক উন্নয়নে সমাজে তাঁদের ভূমিকা ব্যাপক। ধনী এলাকার মসজিদ হবার পরও অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের বিবেকহীন সম্মানী অথবা বেতন শুনে আমাদের হতবাক হতে হয়। আমরা মুসলমানরা মসজিদে আসি আমাদের ইবাদত মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য। একজন ইমাম সাহেব যদি চিন্তিত থাকেন তবে এর প্রভাব তাঁর নামাজের ধ্যানে পড়তে পারে এবং এতে আমাদের নামাজের গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহর নিকট নষ্ট হতে পারে।
অর্থনৈতিক যুক্তি অনুযায়ী দ্রব্যের দাম, শ্রমের মজুরী ইত্যাদি চাহিদা এবং যোগানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে। সম্মানিত ইমাম এবং মুয়াজ্জিন সাহেবগণের সম্মানী এ সূত্র অনুযায়ী হওয়া কাম্য নয়। মুসলীম দর্শন অনুযায়ী আমাদের আত্মিক (রুহানী) শক্তি বৃদ্ধির জন্য সত্যিকারের আল্লাহভক্ত ইমাম সাহেব গণের সহচর্য আমাদের নিজেদের পরকালীন মুক্তির জন্য প্রয়োজন। ঢাকা শহরের উত্তর শ্যামলী এলাকার একজন সম্মানিত ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলে জানা গেলো তাঁর সম্মানী প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এটা মোটামুটি ভালো সম্মানী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। দরিদ্র অঞ্চলের মসজিদ কর্তৃপক্ষের হয়ত বেশী সম্মানী দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ধনী এলাকার মসজিদগুলো বিবেচনাহীন ইমাম এবং মুয়াজ্জিন সাহেবগণের বেতন সত্যি দুঃখজনক।
আসুন আমরা মুসলমানগণ-আমাদের ইবাদতের গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি এবং আমাদের আত্মার সংশোধনের জন্য সম্মানিত ইমাম সাহেবগণের যথাযথ মূল্যায়ন ও সম্মান প্রদর্শন করি। ইবাদতের মধ্যে মহান আল্লাহর কাছে তাই কবুল হয় যা শুধুমাত্র তাঁর জন্য করা হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সব মুসলমানগণকে এখলাস দান করেন।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, সিলেট।