দলই ও রাজনগর বাগানে চা পাতা চয়ন শুরু
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ মার্চ ২০২৩, ৫:৫৯:২৬ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : চা শ্রমিক, বাগান পঞ্চায়েত, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে মৌলভীবাজারের দলই ও রাজনগর চা বাগানে পাতা চয়ন-এর উদ্বোধন করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত শিল্পপতি, দানবীর ড. রাগীব আলীর মালিকানাধীন এ দুটি চা বাগানে পাতা চয়ন শুরু হয়।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা সুব্রত দেবরায় জানান, গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় শ্রমিকদের আনুষ্ঠানিকতা শেষে চা বাগানের ০৫ নম্বর সেকশনে পাতা চয়নের উদ্বোধন করেন সিলেট টি কোম্পানী লিমিটেড এর দলই চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. আসগর আলী।
পরে বাগান কর্তৃপক্ষ, চা বাগান শ্রমিক ও পঞ্চায়েত নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে শ্রমিকরা পূজোর্চনা, গীতাপাঠ, পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত, দোয়া মাহফিলসহ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাগানের চা শ্রমিকদের নিয়ে নতুন পাতা চয়ন করা হয়। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন- দলই চা বাগানের সিনিয়র সহকারি ব্যবস্থাপক বদরুল হুদা চৌধুরী, সহকারি ব্যবস্থাপক মো. আলী আহাদ, সহকারি ব্যবস্থাপক সাদনান চৌধুরী, সাংবাদিক সজীব দেবরায়, সাদিকুর রহমান সামু প্রমুখ। এরপর নাচেগানে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন চা শ্রমিকরা। পরে মৌসুমের প্রথম পাতা উত্তোলন শুরু করেন নারী শ্রমিকরা।
এদিকে, দলই চা বাগানের সেকশনে চা গাছে নতুন কুঁড়ি সবুজের শোভা বর্ধন করেছে। সতেজতায় হাসছে চা বাগান। বাগান কর্তৃপক্ষ ও চা শ্রমিকরাও চা পাতা উত্তোলনে অধীর আগ্রহে। সাধারণত ডিসেম্বরে মৌসুমের শেষে চা গাছ ছাটাই বা কলম এর পর নিয়মানুযায়ী দু’তিন মাস চা বাগানে চা পাতা উৎপাদন বন্ধ থাকে। ফলে চা কারখানাও অলস থাকতে হয়। এরপর নতুন কুঁড়ি গজানোর পর আনুষ্ঠানিকভাবে চা পাতা চয়নের মাধ্যমে শুরু হয় চায়ের উৎপাদন। এবছরও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি।
নারী চা শ্রমিক সারতী সাঁওতাল, আশা বাউরী, বাসন্তী পাশী বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় পূজা ও প্রার্থনার মাধ্যমে চা চয়ন শুরু হয়। চা চয়নের পূর্বে নারী চা শ্রমিকরা একটি চা গাছকে উপলক্ষ করে ফুল ও প্রসাদ দিয়ে পূজা করেন। এটাকে তারা বন দেবীর পূজা বলছেন।
তারা বলেন, এই পূজা করা হয় চা বাগানের সেকশনের বিভিন্ন সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে। নেচে গেয়ে আনন্দঘন পরিবেশে তারা চা চয়নে লেগে পড়েন। এরপর চা বাগান ম্যানেজারসহ সবাই আমাদের সাথে নাচে অংশগ্রহণ করেন।
বাগানের টিলা ক্লার্ক সুনীল তাতী ও পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশাল পাশীসহ চা শ্রমিকরা বলেন, তাদের মজুরী বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু চায়ের দাম না বাড়ায় মালিকরা আছেন সমস্যায়। তারাও চায়ের দাম বৃদ্ধির আবেদন জানান।
তারা বলেন, চা বাগান না থাকলে তাদেরকে না খেয়ে মরতে হবে। তারা চা বাগানের মালিক, ম্যানেজারসহ সকলের সাথে মিলে মিশে কাজ করতে চান যাতে করে চা শিল্পটা এগিয়ে যায়।
দলই চা বাগানের চা শ্রমিক সরদার রাম কুমার বলেন, চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে কিন্তু চা পাতার দাম বাড়েনা কেন? চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি যখন ১৭০টাকা তখন ভালো মানের চা পাতার দাম ১২০টাকা। একজন চা শ্রমিক সে ৫০০ গ্রাম কিংবা ২৫০গ্রাম যাই পাতা তুলুক দিনশেষে তাকে তার প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করতে হয় বাগান কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু চা পাতার দাম আগেও যা ছিল এখনও তাই রয়ে গেছে।
দলই চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. আসগর আলী বলেন, আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে আমরা মৌসুমের প্রথম চা পাতা উত্তোলনের চেষ্টা করি। আনন্দ উৎসবের মধ্যেও আমাদের মন তেমন ভাল নেই। আমরা বৃষ্টির অভাবে ভুগছি। বৃষ্টি না হওয়ায় পানির অভাবে চা গাছ মারা যাচ্ছে, বাগানের চারদিকে পানি দিয়ে আমরা কূলকিনারা পাচ্ছিনা। বৃষ্টি দিলে হয়ত সব ঠিক হয়ে আসবে। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে চায়ের মূল্য নেই, আমরা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের কাঙ্কিত মূল্য পাচ্ছি না। গত কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে ৪০তম চা অকশনে অনেক বাগানের চাপাতা ৯০টাকা ধরে বিক্রি হয়েছে, যদিও আমাদের পাতা ১২০টাকা ধরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু বাজারে চায়ের মূল্য ঠিক থাকলেও আমরা কাঙ্কিত মূল্য পাচ্ছি না। চা বাগানগুলো ও শ্রমিকদের টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
দলই চা বাগানের স্বত্বাধিকারী দানবীর রাগীব আলীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, শুরুতে দলই চা বাগানের বেহাল দশা ছিল। কিন্তু দানবীর রাগীব আলী বাগানটি কেনার পর থেকে উন্নতির মুখ দেখেছে। দানবীর রাগীব আলীকে চা বাগানে এসে চা শ্রমিকদের সাথে সময় কাঠানোর দাবি জানিয়েছেন বাগানের চা শ্রমিকসহ সকলে।
এদিকে, মৌলভীবাজার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা হোসাইন আহমদ জানান, গতকাল শক্রবার রেওয়াজ অনুযায়ী পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও পবিত্র গীতা পাঠের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রজনগর বাগানে চা পাতা চয়ন শুরু হয়। এরপর স্থানীয়ভাবে ‘পাতি উৎসব’ হিসেবে পরিচিত চা পাতা চয়ন উৎসবে সকলকে মিষ্টিমুখ করানো এবং চা শ্রমিকদের পুরস্কৃত করা হয়। আনন্দঘন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, রাজনগর টি কোম্পানীর এজিএম মো. মহসিন, সহকারী ব্যবস্থাপক মো. জুয়েল আহমদ, সহকারী ব্যবস্থাপক শাহাব উদ্দিন আহমদ, ইমাম হাফিজ মাওলানা রায়হান আহমদ, বাগানের পুরোহিত কপিল দের উপাধ্যায় ও পাঞ্চায়েত সভাপতি মন্টু ননিয়া প্রমুখ।
রাজনগর টি কোম্পানীর এজিএম মো. মহসিন বলেন, অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্টি হিসেবে চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে রাজনগর বাগান সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চা শ্রমিকদের আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও জীবনমানের উন্নয়নে আমার কোম্পানী সর্বদা কাজ করেছে। ব্যবসার চেয়ে বাগানের উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে বাগানের স্টাফ ও চা শ্রমিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে অতিথিরা নারী চা শ্রমিকদের মধ্যে শাড়ি ও খাবার বিতরণ করেন।