তেলের প্রবাহ কি স্বাভাবিক হবে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মার্চ ২০২৩, ৭:৪১:৩০ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
যুদ্ধে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। এ অবস্থায় তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা হিসবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে ভøাদিমির পুতিনের রাশিয়া।
বৈশি^ক জ¦ালানি নীতির একজন বিশ্লেষকদের ধারণা, সামনে জ¦ালানি সরবরাহ বন্ধের ঘটনা আরও ঘটতে পারে। তা হতে পারে ইউরোপের দেশগুলোর সরকারের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে ক্রেমলিনের সরাসরি নির্দেশে কিংবা নতুন নাশকতার ঘটনার ফলাফল হিসেবে। সেনা নিযুক্তিতে তেল-গ্যাসকমীদের অন্তর্র্ভূক্ত করায় এ খাতে প্রশিক্ষিত রুশ জনবলের সম্ভাব্য ঘাটতির কারণেও ঘটতে পারে জ¦ালানি সরবরাহ বন্ধের আরও ঘটনা।
নর্ড স্ট্রিম ১ এবং নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইনের ছিদ্র হওয়ার আগে গত মে মাসে রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত জ¦ালানি কোম্পানি গাজপ্রম বেলারুশ ও পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি পাইপ লাইন বন্ধ করে দেয়। গত জুনে গাজপ্রম জার্মানিতে নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়। প্রতিদিন ১৭ কোটি কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে ওই পাইপ লাইনের। কিন্তু জার্মানিতে সরবরাহ কমিয়ে করা হয় দৈনিক মাত্র ৪ কোটি কিউবিক মিটার। কয়েক মাস পরই প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দেয়, পাইপলাইনটি সংস্কার করা প্রয়োজন। এজন্য পুরোপুরি বন্ধ থাকবে এটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নেতাদের অভিযোগ, ইউরোপের দেশগুলোতে জ¦ালানি সরবরাহ আরও বিঘ্নিত করতেই রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এই পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কেননা, নরওয়ে থেকে পোল্যান্ডে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে এক গুরুত্বপূর্ণ নতুন পাইপলাইন চালুর উদ্যোগের মধ্যেই নর্ড স্ট্রিম ১-এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
গ্যাস রফতানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার পরিকাঠামোগত বিকল্প খুবই সীমিত। দেশটির এমন বিকল্প নেই, যার মাধ্যমে তারা সাইবেরিয়া অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাস চীনের মতো গ্রাহক দেশগুলোতে পাঠাতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রাশিয়াকে তার অধিকাংশ গ্যাস অন্য বাজারের পরিবর্তে ইউরোপে বিক্রি করতে হয়।
রাশিয়া ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ না করলে বা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে দিলে সাইরোরিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপগুলোতে উৎপাদন বন্ধ করা প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে গ্যাসখাতের কর্মীরা সেনায় নিযুক্তির জন্য উপযুক্ত হবেন।
রাশিয়ার সেনা নিযুক্তিতে বিভিন্ন তেল কোম্পানির কর্মীরাও রয়েছেন মনোযোগের কেন্দ্রে। তাই রাশিয়া থেকে জ¦ালানি সরবরাহের বিঘ্ন এবার তেলের ক্ষেতেও ছড়িয়ে পড়ে কিনা, কিছু বিশ্লেষক সেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাস্তবে সেটি হলে, তা হতে পারে দুর্ঘটনাবশত কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে।
রাশিয়া থেকে বিদেশে তেল সরবরাহে বিঘ্ন শুরুর একটি সম্ভাব্য তারিখ ৫ ডিসেম্বর, ২০২২। দেশটির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপ করা জ¦ালানি নিষেধাজ্ঞার ষষ্ঠ ধাপ শুরুর চূড়ান্ত সময়সীমা এটি। নিষেধাজ্ঞার বিস্তারিত বিষয়াবলি ও নিষেধাজ্ঞার ফলস্বরূপ রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ক্রেতাদের যে মূল্য চোকাতে হবে, সেটি কীভাবে সমন্বয় করা হবে, এ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এ কারণে এখন পর্যন্ত তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়নি। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞা যখন কার্যকর হবে, তখন বিশ^বাজারে নতুন করে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে।
নতুন ধাপের ওই নিষেধাজ্ঞার অধীন ইউরোপের দেশগুলো সমুদ্রপথে রাশিয়া ধেকে অশোধিত জ¦ালানি তেল কেনা পুরেপুরি বন্ধ করে দেবে। এই পদক্ষেপ যতটা ক্ষতির বলে মনে হচ্ছে, আসলে ততটা নয়। কেননা, এরই মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ তেল কিনতে বিকল্প উৎস বেছে নিয়েছে।
ইউক্রেনে অভিযান শুরুর আগে রাশিয়া কৃষ্ণসাগর এবং বাল্টিক সাগর হয়ে ইউরোপে দৈনিক গড়ে ১৪ লক্ষ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রফতানি করত। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরোপের এই তেল কেনা দিনে ১০ লক্ষ ব্যারেলের নীচে নেমে এসেছে। কিন্তু রাশিয়া ওই পথে ইউরোপের বদলে চিন, ভারত এবং তুরস্কে তেল রফতানি করে তার প্রকৃত সরবরাহ বাড়িয়েই চলেছে।
তেলের ট্যাঙ্কার, ইন্স্যুরেন্স সুবিধা ও জাহাজের মাধ্যমে তেল সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাশিয়ার সুযোগ সীমিত। রাশিয়া সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এসব সেবা প্রধানত ইউরোপ থেকে নিয়ে আসছিল। ষষ্ঠ ধাপের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে চীন, ভারত, তুরস্কের মতো দেশগুলোকে সমুদ্রপথে রুশ মালিকানাধীন বা চাটার্ড জাহাজ থেকে সংগৃহীত তেলের অংশবিশেষ অন্য দেশের পতাকাবাহী জাহাজে স্থানান্তর করতে হবে, সেসব জাহাজ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে। এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া ও সবসময় অবৈধ নয়। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে প্রায়ই এ পন্থা অবলম্বন করা হয়ে থাকে।
ব্যয়বহুল এ প্রক্রিয়ার ক্ষতিপূরণ হিসাবে রাশিয়া তার ব্যারেল প্রতি তেলের রফাতানিতে ৪০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা সাধারণভাবে অনুমান করছেন, ইউরোপীয় ক্রেতারা রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেলের আমদানি কমিয়ে দিলেও মস্কো ঠিকই সেই তেলের বিকল্প ক্রেতা খুঁজে নেবে।
রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের এই বাড়তি বিক্রিবাট্টায় লাগাম টানা লক্ষ্যে কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা। মস্কোর জন্য নৌপথে পণ্য পরিবহনের বিভিন্ন পরিষেবা নেওয়ার সুযোগ কমিয়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ভাড়া, বিমা ও ট্যাঙ্কারগুলোতে কাজ করেন এমন নাবিক পাওয়ার মতো পরিসেবা। পশ্চিমিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, জি-৭ ‘ভুক্ত দেশগুলোর বাইরে তৃতীয় পক্ষ, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে অপরিশোধিত তেল কিনবে তাদের কাছে তেল বিক্রির সময় এই পরিষেবাগুলো পাবে না রাশিয়া।
২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় বিশ^ব্যাপী জ¦ালানী তেলের চাহিদা পড়ে যায়। সে সময় তেলের উৎপাদন কমিয়েছিল রাশিয়া। এবার ইউরোপের দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা হচ্ছে।
এর জেরে ইতিমধ্যে গাজপ্রমের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎও হুমকিতে পড়েছে। এসব পদক্ষেপ থেকে এটাই বোঝা যায়, ক্রেমলিনের হিসেব নিকেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়গুলোকে বড় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না।
অনেকে আবার এটাও বলছেন পরিস্থিতি সামলাতে বিশে^র অন্য দেশগুলোতে তেল সরবরাহ চালিয়ে যেতে চাইবেন ভøাদিমির পুতিন। এক্ষেত্রে সফলতাও পেয়েছে মস্কো। ইউক্রেন যুদ্ধ গুরুর পর একদিনে সর্বোচ্চ ২০ লক্ষ ব্যারেল রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে চীন। বিপুল পরিমাণে রুশ তেল কিনছে ভারত এবং তুরস্কও।
এদিকে, ডিজেলের মতো রাশিয়ার পরিশোধিত জ¦ালানিগুলো আগামী মাস থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। বর্তমানে ইউরোপের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ ডিজেল আসে রাশিয়া থেকে। এতে উল্টো চাপে পড়তে পারে ইউরোপের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ ডিজেল আসে রাশিয়া থেকে। এতে উল্টো চাপে পড়তে পারে ইউরোপের অর্থনীতি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানে, তাদের রাশিয়ার জ¦ালানির ওপর নির্ভরশীলতা শূন্যের কোঠায় আনতে হবে। তবে বিষয়টি এত সহজ নয়। একইসঙ্গে অনেক বিষয় সামাল দেওয়ার পুতিনে যে প্রচেষ্টা, তা তাঁকে চালকের আসনে বসিয়ে রেখেছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।