বাদ যাচ্ছে না চলাচলের রাস্তাও ॥ অভিযোগের আঙ্গুল ‘এসবিএফ’ নামের ইটভাটার দিকে
গোলাপগঞ্জে দুই গ্রামবাসীর মালিকানাধীন জমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ মার্চ ২০২৩, ৭:০৬:৪৭ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটের গোলাপগঞ্জের বাঘা ইউনিয়নে ‘এসবিএফ’ নামের তিনটি ইটভাটায় জমি কেটে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মর্মে অভিযোগ উঠেছে। চলাচলের রাস্তা কেটে ফেলা এবং গহীন গর্ত তৈরি করে অসহায় মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙনের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে ইটভাটা মালিক পক্ষ। তিনটি ইটভাটারই মালিক একটি পরিবার। আর এই অভিযোগ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, মুরাদপুর গ্রামের ছানা মিয়া, তার ভাই কাচা মিয়া এবং ওলি’দের বিরুদ্ধে।
তুরুকভাগ-খালপাড় গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর তীরে প্রায় ৩০ ফুট গভীর গর্ত খুড়ে মাটি ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, ইটভাটার দুইশ’ মিটার দূরে এই জায়গাটির ঠিক পাশে কয়েকটি হতদরিদ্র পরিবারের বসবাস। ঘরবাড়ির সীমানাঘেঁষে গহীন গর্ত তৈরির কারণে বাড়িগুলো ভেঙে বিলীন হওয়ার উপক্রম। এরই মধ্যে একটি শৌচাগার ভেঙে পড়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকলেও বসবাসরত পরিবারগুলো প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না।
ঝুঁকিতে থাকা পরিবারের এক নারী এগিয়ে এসে এই প্রতিবেদককে তার ঘরের বর্তমান অবস্থা দেখার অনুরোধ করেন। এগিয়ে গেলে ওই নারীর স্বামী চান মিয়া জানান, ইটভাটার ধুলোর কারণে একদিকে তারা এ বাড়িতে শান্তিতে থাকতে পারছেন না ; অন্যদিকে, ঘরের ঠিক পাশে গহীন গর্ত খোঁড়ার কারণে তার ঘরটি ঝুঁকিতে পড়েছে। ইট-গাঁথুনির ঘরটিতে এরই মধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারছে না তিনিসহ আশপাশের পরিবারগুলো।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, ‘কিছুদিন আগে খালপাড় গ্রামের হাওরে যাতায়াতের রাস্তাও কেটে দিয়েছেন কাচা মিয়া। ফলে গ্রামের লোকজন কৃষি কাজে কিংবা গরু-মহিষ চরাতে হাওরে যেতে পারছেন না। প্রতিবাদ করায় গ্রামের লোকজনকে নানাভাবে হয়রানিও করছেন তারা।’ যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাচা মিয়া।
এ ব্যাপারে এলাকাবাসী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবরে অভিযোগ দিয়েছেন। এতে স্বাক্ষর করেছেন মো. লাল মিয়া, দুদু মিয়া, মনজুর হোসেন, ফটিক মিয়া, আজির আলী, উছমান মেম্বার, কিবরিয়া, টেনু মিয়াসহ অনেককে। ১ মার্চ দেওয়া এই অভিযোগের অনুলিপি সিলেটের জেলা প্রশাসককেও দেওয়া হয়।
গত কয়েক বছর ধরে দুই গ্রামের লোকজনের মালিকানাধীন বেশ কয়েক একর জায়গা থেকে এভাবে মাটি কেটে নিয়েছেন ছানা ও কাচা মিয়ার লোকজন। কাচা মিয়াদের বিরুদ্ধে যে কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। খালপাড় বাজারে দেখা হয়, সাবেক এক ইউপি সদস্যের সঙ্গে। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলে তিনি প্রথমে মুখ খুলতেই চাননি। তেমন কিছু জানেন না বলে জানান। পরে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘কাচা মিয়াদের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায় না কেউ। কথা বললে তাদের উপর অত্যাচার নেমে আসে। তাদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে।’
তুরুকভাগ গ্রামের নজরুল ইসলাম নামের এক যুবক বলেন, ‘কাচা মিয়া, সাবেক চেয়ারম্যান ছানা মিয়া ও তাদের ভাই ওলি এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি দুর্বল কাউকে পেলে ধরে নিয়ে অমানষিক নির্যাতন চালানো হয়। এতদিন সহ্য করলেও এখন দুই গ্রামবাসী প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন।’
কেবল হতদরিদ্র পরিবার নয়; প্রতিষ্ঠিত অনেক পরিবারের জমিও বাদ যায়নি কাচা-ছানার সহযোগীদের কবল থেকে। তুরুকভাগ গ্রামের উচ্চশিক্ষিত একটি পরিবার যাদের বেশিরভাগই গ্রামে বসবাস করেন না। তাদের অবর্তমানে সম্প্রতি তাদের কয়েক বিঘা জমিতে গর্ত করে মাটি নিয়ে যান কাচা মিয়া। টেলিফোনে এ পরিবারটি কাচা মিয়ার কাছে মাটি নিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি দোষ স্বীকার করে দ্রুত মাটি প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ছয় মাসেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেননি।
খালপাড় ও তুরুকভাগ গ্রামবাসীর অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করেছেন গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুনূর রশীদ চৌধুরী। তবে এ বিষয়ে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি বলেছেন, ‘গ্রামবাসীর অভিযোগ পেয়েছি। তবে, কাচা মিয়া এসব জমি তার নিজের দাবি করেছেন। আমি গ্রামবাসীকে কাগজপত্র নিয়ে থানায় আসতে বলেছি।’
তবে, উপজেলা প্রশাসন থেকে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী মান্নানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি তার স্মরণে নেই। কাগজ দেখে পরে বলতে পারবেন।
বাঘা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ জানান, এদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। কয়েকবার তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা কোনোকিছুই মানছে না। গত বৃহস্পতিবার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে জানান তিনি।
তবে এ ব্যাপারে উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।
এদিকে তার বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাচা মিয়া। মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘একটি ভূমিখেকো চক্র তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। রাতের অন্ধকারে তার জমি থেকে মাটি কেটে নিয়েছে। এর প্রতিবাদ করায় তারা তার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে উপজেলা প্রশাসন ও থানায় অভিযোগ দিয়েছে।’
গ্রামের রাস্তা কেটে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি আমার ক্রয় করা জমি। এখানে তফসিলি কোনো রাস্তা নেই। মাটি কেটে ফিশারি করতে চেয়েছি। তখন খালপাড় ও তুরুকভাগের লোকজন এসে বলেছে এটি তাদের হাওরে নামার রাস্তা।’ ইটভাটার পাশে নদী তীরবর্তী পুকুর মতো গহীন গর্ত খোড়ার অভিযোগটিও তিনি অস্বীকার করেন।