টাকার খেলা খেলা নয়, মরীচিকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ মার্চ ২০২৩, ৮:০৯:২১ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
দেশের পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ার প্রতি নজর দিলে দেখা যাবে কতোজন কতো কথাই হরদম বলে বেড়াচ্ছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি কখনো বা স্বাস্থ্যনীতিসহ কতো জ্ঞানই না বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের কণ্ঠসমূহ থেকে উচ্চারিত নীতিবাক্য শুনতে শুনতে মানুষ নানা কায়দায় বিরক্তি প্রকাশ করছেন। তাতেও কেউ থামছেন না। বকাউল্লাহ সীমাহীন। শোনাউল্লার সংখ্যা কতো কে জানে।
তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার মুখ-নিসৃত কোন কথা হাল্কাভাবে বা গুরুত্বহীনভাবে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আমরা চাই আমাদের গবেষণা সবসময়ই চলবে। কিন্তু একটা দুঃখের কথা না বলে পারি না। সেটা হলো আমাদের কৃষি গবেষণা চলছে, বিজ্ঞানের চলছে, কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যখাতে গবেষণা খুবই সীমিত। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় বিশেষ মনোযোগ দিন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, ‘ডাক্তারদের একটি মহল এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর চিকিৎসা চর্চা ও গবেষণা বাদ দিয়ে সরকারি চাকরি অথবা রাজনীতিতে চলে যান। আর একটি শ্রেণি আছেন, তারা শুধু টাকা কামাতেই ব্যস্ত। সরকারি চাকরি আর প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পর সেখানে কিন্তু আর গবেষণা হয় না। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের গবেষণা খুবই সীমিত কয়েকজন করেন।’
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ের গবেষণার ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করলেও তিনি কিন্তু আশাবাদী মানুষ। দেশ ও জাতির মঙ্গল চিন্তায় তিনি কখনো নিরাশ হন না। তাইতো তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের গবেষণা খুবই সীমিত কয়েকজন করেন’। সত্যি কথা বলতে কি, ‘এই সীমিত কয়েকজনইতো আমাদের ভরসা। ‘এই সীমিত’ ত্যাগী মেধাবী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডাক্তারদের সাথে আমাদের নতুন প্রজন্মের ডাক্তারদের সমাবেশ ঘটলে গবেষণায় গতি যে ফিরে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ আমাদের নতুন প্রজন্ম মেধার দিক দিয়ে বিশ্বের কারো থেকেই কম নয়। এখানে বিবেচ্য বিষয়টি মেধার নয়। মানসিকতার। তাই মানসিকভাবে তৈরি হলে অনেক কঠিন কাজও সহজ হতে বাধ্য। আমরা যদি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথাই বিবেচনা করি তাহলে দেখবো বাংলার কোমলমতি সহজ-সরল-শান্ত-নিরীহ তরুণ সমাজ বঙ্গবন্ধুর ডাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছিলো বলেই অস্ত্র হাতে মৃত্যুর মুখোমুখি হতেও দ্বিধাবোধ করেনি। আর মানসিকতার কারণেই আজ আমরা আমাদের সাধের বাংলাদেশ পেয়েছি। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারবো না কেন! আমাদের তরুণ-মেধাবী-অভিজ্ঞ ডাক্তার সমাজ এগিয়ে এলে সবকিছুই সম্ভব হয়ে উঠবে!
‘আর টাকা কামাই’? এটা সত্য যে এই টাকা ছাড়া জীবন অচল কিন্তু টাকাই জীবনের সবকিছু নয়। এটা জীবন-যাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাত্র। ব্যক্তি এবং জাতির জীবনে সম্মিলিতভাবে সুখী হওয়ার প্রবল ইচ্ছাই একটি সুখী জাতির প্রত্যাশা।
কিন্তু এটা দুঃখজনক যে এই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। ‘বড় হওয়ার মাপকাঠি যে আজ এই টাকা। এটি তো কখনো কাম্য হতে পারে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো দুঃখ করেই বলেছেন, ‘মানুষের সকলের চেয়ে সত্য ইচ্ছা হচ্ছে বড় হওয়ার ইচ্ছা, সুখী হওয়ার ইচ্ছা নয়।’ কিন্তু আমরা তো সুখী হতে চাই। হাসপাতালের রোগীও চায় সুস্থ হয়ে সুখী হতে। এই হাসপাতাল সম্পর্কে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল বলেছেন- ‘হাসপাতালের প্রথম শর্ত হচ্ছে, এটি অসুস্থদের ক্ষতি করবে না।’ এ বিষয়ে স্যামুয়েল গোল্ড উইন বলেন, ‘হাসপাতাল অসুস্থ হওয়ার কোন জায়গা নয়।’ কিন্তু আমাদেরকে মাঝে মাঝে এইসব বিখ্যাত উক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সংঘটিত ঘটনা দেখতে হয়। কেউ কেউ বলবেন এগুলো নিতান্তই বিক্ষিপ্ত ঘটনা মাত্র। হয়তো বা তাই। তবে এই বিক্ষিপ্ত ঘটনাই মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলে। হাসপাতাল তথা চিকিৎসাসেবার ভাবমূর্তিতে কলঙ্কের ছাপ এঁকে দেয়। ২.৩.২০২৩ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার একটি শিরোনামই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যার শিরোনামটি হলো, ‘শ্লীলতাহানি, খুলনায় দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা’। খবরটিতে বলা হয়, ‘নুসরাত আরা ময়না আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশু কন্যাকে নিয়ে আবু নাসের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ শিশুটিকে ভালো চিকিৎসার জন্য খুলনার শেখপাড়ায় হক নার্সিং হোমে ভর্তি করতে বলেন। সেখানে ভর্তি হলে ১৮ জানুয়ারি শিশুটির বাঁ হাতের আঙ্গুলে সার্জারি করা হয়। পরে এই ক্লিনিকেই নিয়মিত ড্রেসিং করা হয়। কিন্তু এর মধ্যে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ মোবাইলে শিশুটির মাকে অনৈতিক প্রস্তাব দিতে থাকে। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি পুনরায় ড্রেসিং হোমে শিশুটিকে অপারেশন কক্ষে রেখে ওই চিকিৎসক তার মাকে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি ঘটানোর এক পর্যায়ে তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। ভুক্তভোগী নুসরাত আরা ময়না বলেন, মেয়েকে জিম্মি করে জোরপূর্বক তাকে শ্লীলতাহানি করা হয়। কিন্তু তিনি রাজি না থাকায় চিকিৎসা অবহেলায় তার মেয়ের হাতের একটি আঙ্গুলের অর্ধাংশ নষ্ট হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ এরপর যা হবার তাই হয়েছে। নুসরাত আরা ময়না ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ ও হক নার্সিং হোমের মালিক নুরুল হক ফকিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নুসরাতের আত্মীয় স্বজন ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ এর ওপর হামলা করায় খুলনার সকল সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এখন স্বাভাবিক প্রশ্ন এসে যায়, হামলাকারীদের বিচার তো অবশ্যই হতে হবে কিন্তু ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনে মামলা হয়েছে সেটাওতো খতিয়ে দেখতে হবে। আইনের ঊর্ধ্বে তো কেউই নন। আর হাসপাতালের রোগীদের কথাও তো একবার ভেবে দেখতে হবে। তাদের দোষটা কী? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো ভুক্তভোগী নুসরাত আরা ময়নার আগুনে পোড়া শিশু কন্যাটির অবস্থাতো আমরা কেউ বলছি না। কি অপরাধ সেই অসহায় শিশুটির? আর নুসরাত আরা ময়নার আনীত অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ এর কর্মকাণ্ডটিকেওতো ধর্তব্যের মধ্যে আনা উচিত। আর এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে, রোগীরা কিন্তু একজন ডাক্তারকে ‘ঘবীঃ ঃড় এড়ফ’ হিসেবেই শ্রদ্ধা করে থাকেন।
ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ সাহেব ‘ঘবীঃ ঃড় এড়ফ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কিনা সেটাও তদন্ত করে বের করা জরুরি। একটা ব্যস্ত হাসপাতালে গিয়ে তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখলে প্রতীয়মান হবে যে কর্তব্যরত ডাক্তারগণ যেন রোগের বিরুদ্ধে এক মরণপণ যুদ্ধাবস্থায় অবস্থান করছেন। এখানে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলগত দাবি দাওয়া একেবারেই গৌণ বিষয়। যুদ্ধ জয়ই মুখ্য। যেমন যুদ্ধাবস্থায় কোনো দেশের বীর সেনানীদের অবস্থা। সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালে সেই দেশের সেনাবাহিনী যদি দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য অস্ত্র ফেলে কর্মবিরতি পালন করতে যান তাহলে যুদ্ধ বা নিজ দেশের কি পরিণতি হবে তা কি ভাবা যায়?
এ বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকেই জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। কারণ এই বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলোই অনেক সময় জাতিকে ভাবিয়ে তোলে।
শুরু করেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই সাহসী উক্তি- ‘ডাক্তারদের এক শ্রেণি আছেন তারা শুধু টাকা কামাতেই ব্যস্ত’ দিয়ে। এই ‘টাকা কামানো’র কারণে দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা ব্যাহত হচ্ছে। গবেষণা কাজে সংশ্লিষ্টজন চরম অনীহা প্রকাশ করেছেন। ফলে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন নতুন আবিষ্কার থেকে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু রোগাক্রান্ত মানুষ তো রোগ থেকে মুক্তি চায়। এই রোগমুক্তির মানসে যার যার সাধ্যমতো বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন। যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল তারা লণ্ডন-আমেরিকা-সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন।
মধ্যবিত্তরা নিদেন পক্ষে ভারতগামী। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কে না সুস্থ হতে চায়। আমাদের দেশে ক্রীড়া সাংবাদিক রয়েছেন। তারা খেলাধুলার খবরাখবর জাতির সামনে তুলে ধরেন। দেশ-বিদেশের চিকিৎসার খবরাখবর বিষয়ে চিকিৎসা বিষয়ক সাংবাদিক যদি থেকে থাকেন তাহলে তাদের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে বলবো দয়া করে ভারতের চেন্নাই, ভেলোর, হায়দ্রাবাদ বা দিল্লির হাসপাতালগুলো একবার ঘুরে এসে একটা রিপোর্ট জাতির সামনে উপস্থাপন করুন। দেখবেন ঐসব হাসপাতালে বাংলাদেশিদের সংখ্যা কতো। আর এতে বাংলাদেশের কতো বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে চলে যাচ্ছে। আর এই চলে যাওয়া, সেতো শুধু উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হতদরিদ্রদের তো এক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। তাদের ভরসা তো ‘শুধু টাকা কামাতেই ব্যস্ত’ দলটিই। এ দলটির হাতে জিম্মি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী। দেশের চিকিৎসা খাতের কাণ্ডারী যারা তাদেরকেই তো এ নিয়ে ভাবতে হবে। সীমান্ত পাড়ি দেবার ক্ষমতা তো তাদের নেই।
সেদিন একটি খবরে আমার বুকটা গর্বে ভরে গেছে। এক ভদ্র মহিলা জানালেন তার বোন ভারতের মেঘালয় সীমান্তে থাকেন। তথাকথিত চোরাই পথে তার বোনটি সিলেটে এসে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে ভারতে চলে গেছে। ভারতে বসবাস করেও চিকিৎসার জন্য তার দক্ষিণ ভারতের কোন হাসপাতালে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি বলেই তার সিলেটে আসা। জানলাম তার বোনটি সিলেটের ডাক্তারদের চিকিৎসায় আজ সুস্থ। রোগীটির নাম বেলা। বেলার উদ্দেশ্যে বলছি- বেলা, বেলা-অবেলায় তুমি বাংলাদেশে এসো। এসো তোমরা দলবেঁধে। সিলেটের ডাক্তার ভাইয়েরা আজ নতুন খেলা শুরু করছেন। এ খেলায় জিতলে বন্ধ হবে টাকার খেলা। টাকার খেলাই শেষ খেলা নয়। এ যে শুধুই মরীচিকা।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।