শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক হই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মার্চ ২০২৩, ৪:৫৯:৫১ অপরাহ্ন
পাপড়ি রাণী রায়
আমরা সবাই একটি কথা জানি যে, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের বুদ ভবিষ্যৎ। বয়সে শিশু বড় হবে না বড় হবে জ্ঞান-গরিমায়, বিদ্যা বুদ্ধিতে। তারপর তারা গ্রহণ করবে সমাজ তথা রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্ব। তাই শিশুর মানসিক বিকাশে পুরো দায়িত্ব পালন করতে হবে। হয়তো কোন শিশু হবে ডাক্তার, কেহ বিজ্ঞানী, কেহ শিক্ষক, কেহ ব্যবসায়ী আবার কেহ রাষ্ট্র নেতা। সদ্য যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করলো, তাকে ঘিরে পিতামাতার স্বপ্নের কত মেলা। স্বপ্ন দেখে পরিবারের প্রতিটি সদস্য। তো কী স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে শিশু একদিন বড় হয়ে শুধু পিতা-মাতা নয় সমাজ তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। শিশুর সুস্থতা শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ তাকেই বোঝায় না। শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ না হলে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। শিশু যখন বেড়ে ওঠে তখন তার চারপাশের পরিবেশ অনেকটাই প্রভাবিত করে। একটি শিশুর নির্ভয়, নিরাপদ শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবারের সবার।
পরিবার হলো শিশু বিকাশের প্রথম স্তর। শিশুর বাসগৃহ যদি সুন্দর, মনোরম পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে সবাই সচেষ্ট থাকে তাহলে সে শিশু সদ্য ফোটা ফুলের মতই বিকশিত হবে। পরিবারের গুরুত্ব শিশু বিকাশের অন্তরায় যেন না হয় সেই বিবেকবোধটুকু সকল সদস্যদের মাথায় রাখতে হবে। শিশুরা খুব আদর পিয়াসী অনুকরণশীল হয়। এগুলো প্রতিটা শিশুর বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান।
একটি শিশুকে শিশু বয়স থেকেই শিক্ষামূলক বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ প্রসারিত হবে এবং মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়বে এবং নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হবে। পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
প্রত্যেকটা শিশু অনুকরণশীল। বড়রা যা করবে শিশু তা রপ্ত করে নেয়। শিশুর মন নরম মাটির মত তুল তুলে যা দেখে সে তার মনে বীজ বপন করে ফেলে। কাজেই শিশুর সামনে অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে তার খেয়াল রাখতে হবে। সুশিক্ষার একটি আদর্শ পরিবেশ যাতে বিরাজ করে পরিবারে তার জন্য সচেতনতার মুখ্য ভূমিকা পালন করা আবশ্যক।
শিশুর মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। কাজেই শিশুর খেলনা সামগ্রী হবে সৃজনশীল। বয়স ভেদে খেলনা সামগ্রী নির্বাচন করতে হবে। শিশুরা খেলাধুলায় খুব আগ্রহী হয়। খেলাধুলা করলে শিশুর বুদ্ধিমত্তা বাড়বে এবং মেধা বিকশিত হবে।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে অল ফর চাইল্ড, চাইল্ড ফর অল, তাছাড়া শিশুকে হ্যাঁ বলুন। বাধা দিতে নেই যেমন তুমি এটা করবে না, ওটা ধরবে না, ওখানে যেও না অর্থাৎ সারাদিন শিশুর পেছনে লেগে থাকা। অমন করলে শিশু বেড়ে ওঠাতে বাধাগ্রস্ত হয়ে যাবে। কাজেই শিশুকে উন্মুক্ত চলাফেরা মানে অবাধবিচরণ এর জায়গা করে দিতে হবে। এতে শিশুর মেধা বিকশিত হবে। কথায় আছে, হেলথ ইজ ওয়েলথ অর্থাৎ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রোগবালাই এর দিকে নজর রাখতে হবে। শিশু যাতে অসুস্থতায় না ভোগে সে ব্যাপারে পিতামাতাকে যতœশীল হতে হবে। রোগাক্রান্ত শিশুর ভবিষ্যৎ বর্তমান দুটাই খারাপ। শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকলে শিশুরা ফুট ফুটে চাঁদের মত বেড়ে ওঠবে আর মেধা বিকাশে সক্ষম হব।
নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পরধর্মে সম্মান দেখানোর ভাব শিশুর মাঝে বিরাজ করার নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
পিতামাতার সাথে শিশুর সম্পর্ক হবে বন্ধুতার। এমন আচরণ শিশুর সাথে করা উচিত যাতে করে শিশু তার পিতা মাতাকে ভয় না পায়। ভয়ের মধ্যে শিশু বসবাস করলে মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে ঝরে পড়ে। নিরাপদ আশ্রয় আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে শিশু বেড়ে ওঠলে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে। ভালো প্যারেন্টিং শিশুর মানসিক, ভাষাগত এবং আবেগ প্রবণতার সঠিক বিকাশ ঘটিয়ে আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
শিশুর প্রতি সহনশীলতার হাত বাড়াতে হবে। ওরা অবুঝ একথা পরিবারের সবার মাথায় রাখতে হবে। শিশুর কাছে সবচেয়ে আপন তার পিতা মাতা। তাই পিতামাতার কাছ থেকে যেন শিশুরা দূরে চলে না যায় সেই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে অক্ষরে অক্ষরে। পিতামাতার সাথে সুন্দর সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন হলে শিশুরা বিকশিত হবেই হবে।
প্রাতঃকালে ভ্রমণে সারাদিন ভালো কাটে। ভোরের বাতাস শরীরের জন্য খুব ভালো। তাই প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। ভোরের সূর্য ওঠার দৃশ্য, পাখির গান, সবুজ প্রকৃতি, নির্মল বাতাস শিশুর মনকে আনন্দে আন্দোলিত করবে। ভোরে ওঠা শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
শিশুর সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে হলে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা মা, দাদিমা, ঠাকুরমার মুখে কত কল্পকাহিনীর গল্প শুনেছি। ঠাকুরমার ঝুলি গল্পের বিকল্প নেই। শিশুরা গল্প শুনতে খুব উৎসুক। কারণ শিশুরা গল্প শুনে কল্পনার রাজ্যে ডুবে যায়। ভেসে বেড়ায় নতুন নতুন স্বপ্নে। এতে করে শিশুর মনে নতুন প্রজন্মের জন্ম দেয় অজানাকে জানতে চায়। তাই শিশুর মানসিক বিকাশে ভালো গল্পের জুড়ি মেলা ভার।
ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের বিকাশ শিশুর মনে শৈশব থেকেই জাগ্রত করতে হবে। মহামনীষীদের উপাখ্যান শিশুদের শোনাতে হবে। প্রার্থনা করা সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস অটল থাকা এসব শিখতে হবে শৈশবেই।
শিশুকে স্বাধীনতার সুযোগ দিতে হবে। পিতা মাতাকে খেয়াল রাখতে হবে কোন বিষয়গুলো শিশুর কাছে অতীব প্রিয়। শিশুর স্বাধীনতায় ব্যাঘাত না দিয়ে তাকে সাহায্য করতে হবে। তবেই তো বিকশিত হবে শিশু।
শিশুর প্রধান বৈশিষ্ট্য আপনি যা করেন তা সে করবেই। তাই ভালো মন্দের দিকটা মাথায় রাখতে হবে। কোন কারণে পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ হলে তা মিটিয়ে নেওয়া ভালো। শিশুর সামনে অমানবিক কাজগুলো করা যাবে না। এতে শিশুর মানসিক চাপ বাড়ে। ফলে বিকশিত হতে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ হবে নির্মল বিশুদ্ধ পরিবেশ। বিশুদ্ধ পরিবেশের শিশুরা বিকশিত হয়ে গড়ে ওঠে।
অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য পরিবারের সকল সদস্যরা মেলবন্ধনের মাঝে বাস করতে হয়। শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ যদি আনন্দময় না হয় বা শিশু লালন পালনে ত্রুটি থাকে তাহলে সে শিশু কোন অবস্থাতেই বিকশিত হতে পারবে না। (যেমন ২০১৩ সালে নিজ গৃহে পিতামাতাকে ঐশী হত্যা করে)। হাইকোর্টে ঐশীর মৃত্যুদ-ের সাজার দাবি উঠলে বিচারকম-লী ঐশীর পিতা-মাতার লালন পালনের ভূমিকায় প্রশ্ন তোলেন। কাজেই শিশুর মানসিক দিকটা আমাদের মাথায় রেখেই শিশুর অনাবিল আনন্দের পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের উপরই ন্যাস্ত।
শিশুরা খুবই আবেগপ্রবণ হয়। তাই শিশুদেরকে ধমক দিয়ে কথা বলা যাবে না। মধুর সুরে কথা বললে শিশুরা তা সুন্দর পালন করে। শিশুর উপর যত অভিযোগ তা কারও সামনে বলা যাবে না। এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে শিশুর মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে হবে।
পিতামাতার হৃদ্যতার সম্পর্ক দেখলে শিশুরা অনুপ্রাণিত হয়। কাজেই আপনার শিশুর জন্য পিতা-মাতাকে শিশুর সামনে উপস্থাপন করতে হবে নিখুঁতভাবে। সত্যি সত্যি আপনাদের মিল মহব্বত দেখে শিশুরা গর্বিত হয়। শিশু কিন্তু যতটা মাকে চায় ততটাই বাবাকেও চায়। পিতা মাতার ভূমিকা একটি শিশুর মানসিক বিকাশের হাতিয়ার। শিশুর কাছে সবার চেয়ে আপনার পিতা-মাতার স্থান।
শিশুদেরকে মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া খুবই দরকার। এতে শিশু তার আপনজনদের চিনতে পারবে। খুশি হবে আর এক আত্মিক বন্ধন নিবিড়ভাবে গড়ে ওঠবে। শুধু আত্মীয় স্বজনের বাড়ি নয়। শিশুকে নিয়ে পার্ক বা ঐতিহাসিক স্থানে নিয়ে বেড়াতে গেলে শিশুরা অজানাকে জানার কৌতুহল জাগবে। এতে শিশুর মানসিক বৃদ্ধি লাভ হবে।
শিশুকাল থেকেই শিশুকে সত্যের আদর্শে বড় করতে হবে। মিথ্যা আর সত্যের পার্থক্য বোঝাতে হবে। সর্বদা সত্য কথা বলার নির্দেশ দিতে হবে। তাছাড়া সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, ধৈর্যশীল, সংযম, মানবতাবোধ এসব গুণাবলির আদর্শে শিশুকে গড়ে তুলতে হবে। এতে করে শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব।
পরিশ্রম সফলতার চাবিকাঠি। তাই শিশুকে পরিশ্রম এর ব্যাপারে শিখাতে হবে। যে শিশু পরিশ্রমী হবে সে শিশু বিকশিত হবেই হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশুকাল থেকেই শিশুকে দেশের প্রতি ভালোবাসা মমত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। যেমন জাতীয় দিবসগুলো ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ, তাছাড়া বসন্ত উৎসব, ১লা বৈশাখ এসব বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। তবেই তো শিশুর মানসিক বিকাশে পূর্ণতা পাবে।
শিশুর মানসিক বিকাশে একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকাও অপরিসীম। কারণ শিশুরা শিক্ষকের কথা দারুন মনোযোগ দিয়ে পালন করে। এখানে শিক্ষক ও লেখাপড়ার সাথে সাথে শিশুকে অনেক আদেশ উপদেশ, অজানা তথ্য, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার এবং পাঠদান করবেন মনোরম পরিবেশ তৈরি করে। তবেই শিশুর মানসিক বিকাশ শত ভাগ সফল হবে। শিক্ষক-ওতো পিতা-মাতার মতই শিশুর জীবনে। তাছাড়া শিক্ষক সময়ের সদ্বব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারেন। সময়কে কাজে লাগানো এবং সময়ের দাম দিতে পারার মনোভাব শেখানোর ব্যাপারে শিক্ষকের ভূমিকা এখানে সক্রিয়। কবি সুকান্ত শিশুদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন দেখতেন বলেই মাত্র একুশ বছরের কবি লিখে গেছেন-
অমৃত সুধায় ভরা পঙক্তিমালা-
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য
করে যাব আমি নবজাতকের কাছে
এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
শিশুকে শুধু নিজের শিশু না ভেবে ভাবি, শিশু হলো জাতির কর্ণধার। তাই শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশের বিশেষ যতœ নিয়ে একজন সুনাগরিক করে গড়ে তোলার প্রয়াসে ব্রতী হই। শিশুর মানসিক বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়েও পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট।