সিলেটের আদিকথা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২৩, ৩:১৯:৪৬ অপরাহ্ন

সিরাজ উদ্দীন হুসাইনী
মানব জাতির আদিপিতা প্রথম মুসলমান হযরত আদম আলাইহিসালাম ভারতবর্ষে সুভাগমন করেছিলেন। সিলেট ভারতেরই একটি অংশ।
হযরত আদম (আ.) এর অধঃস্তন সানী আদম হযরত নূহ (আ.) এর যামানায় মহাপ্লাবনে ৮০ জন মতান্তরে ১২০ জন ঈমানদার মুসলমান নারী-পুরুষ ব্যতিত পৃথিবীর সমস্থ মানুষ ধ্বংস হয়ে জান। তাদের মধ্যে হযরত নূহ (আ.) এর তিন পুত্র হাম, সাম ও ইয়াফেস ব্যতিত কারো কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন নাই। সবাই ছিলেন নিঃসন্তান। তাই হযরত নূহ (আ.) কে বলা হয় সানী আদম। এই তিন ঈমানদার মুসলমানের বংশ বিস্তার লাভ করে পৃথিবী ভরপুর হয়েছে। এই তিনজনেরই একজন ইয়াফেসের বংশ দ্বারা চীন, রাশিয়া ও ভারত ভরপুর হয়েছে। সেই সূত্রে সিলেটের আদি বাসিন্দা সেই বংশেরই।
প্রাচীনকালে ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। হরিকেল নামক একটি এলাকা কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গবেষকদের অভিমত হল, হরিকেল সিলেটের একটি নাম।
কালক্রমে মানুষ সমাজ ও ধর্মের প্রবর্তন করে। মুসলমানদের বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু ধর্ম প্রচলিত ছিল। ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও চীন স¤্রাজ্যের সংগে আরব বণিকগণের বাণিজ্যিক যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। ৬১০ ঈসায়ী আরব দেশে মক্কা নগরে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম পবিত্র ইসলামধর্ম সংস্কার করেন। ৬৩৬-৬৩৭ ঈ. হযরত ওমর (রা.) এর খিলাফত কালে মুসলমানগণ ভারত অভিযান আরম্ভ করেন। ৭১২ ঈ. মুহাম্মাদ বিন কাশিম সিন্ধু বিজয় করেন। সে বিজয়ের ধারাবাহিকতায় ভারতের সর্বত্র মুসলমানদের বিজয়ী পতাকা পতপত করে উড়ে।
পুরাকালে সিলেটের টুলটিকর এলাকায় ১৩টি মুসলিম পরিবার বাস করতেন বলে জানা যায়। তাঁদের মধ্যে বুরহান উদ্দীন নামক একজন ধার্মিক ব্যক্তির পুত্র সন্তানের জন্ম হলে গরু জবাই করে তিনি ইসলামের বিধান আকিকা পালন করেন। তখন সিলেটে গৌড় রাজ্যের রাজা ছিলেন গৌড় গোবিন্দ। তিনি গো-হত্যার অপরাধে বুরহান উদ্দীনের হস্ত কর্তন করেন এবং পুত্র সন্তানকে হত্যা করেন। এর প্রতিশোধ নিতে তিনি দিল্লীর স¤্রাট ফিরোজ শাহ তোগলকের শরণাপন্ন হন। স¤্রাট সিকন্দর গাজীকে গৌড় অভিযানের আদেশ দেন। তিনি অভিযানে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। স¤্রাট সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে সিপাহসালার নিযোক্ত করে সিকন্দর গাজীকে সাহায্য করার জন্য একদল সৈন্য পাঠালেন। পাথিমধ্যে ৩১১ জন সহচর সহ হযরত শাহ জালাল (রাহ.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিন বাহিনীর সামরিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বলে ১৩০৩ ঈ. দরবেশ হযরত শাহ জালাল (রাহ.) সিলেট জয় করে মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) এর বড় ভাই হযরত জাফর (রা.) এর অধঃস্তন বংশধর মীর হাজারা ইসলাম প্রচারের জন্য সম্ভবত ১৩২২ ঈ. সিলেটের রুস্তমপুরে প্রথমত বসবাস করেন। অতঃপর গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ীতে চলে যান। মীর হাজারার এক মাত্র পুত্র আল্লাহর ওলী বলিওর হাজারা ইসলাম প্রচার ও ধর্ম-কর্মে নিয়োজিত থেকে রাজ্য শাসন করতেন।
প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী ফুলবাড়ী আজিরিয়া মাদ্রাসা মীর হাজারার অধঃস্তন পুরুষ মাওলানা আজির উদ্দীন ১৮৬০ ঈ. প্রতিষ্ঠা করেন। মীর হাজারার উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র মাওলানা আব্দুল মতিন চৌধুরী শাইখে ফুলবাড়ী ১৮১৫ ঈ. জন্মগ্রহণ করে ১৯৯০ ঈ. ইন্তেকাল করেন।
ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় সিলেটের অবদান অবিস্মরণীয়। ফুলবাড়ী মাদ্রাসার পরে প্রতিষ্ঠিত হয় কানাইঘাটের ঝিঙ্গাবাড়ী মাদ্রাসা। অতঃপর ১৮৮৯ ঈ. দারুল উলুম কানাইঘাট মাদ্রাসা, ১৮৯৮ ঈ. কানাইঘাটের উমরগঞ্জ মাদ্রাসা, ১৯০১ ঈ. গাছবাড়ী জামিউল উলুম মাদ্রাসা, ১৯১০ ঈ. সিলেট সদরের রাজারগাঁও ইমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসা ও ১৯১৩ ঈ. সিলেট শহরে সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিলেটের নয়া সড়কস্থ খেলাফত বিল্ডিং এ ১৯২৩ ঈ. মারকাজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সর্ব প্রথম পবিত্র হাদিস শরীফের দরস আরম্ভ করেন কুতবে আলম- শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)। অতঃপর ১৯২৯ ঈ. গাছবাড়ী মাদ্রাসায় হযরত মাওলানা আহমদ আলী শাহ সাহেব (রাহ.) ও ১৯৩৭ ঈ. সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় হযরত মাওলানা সহুল উসমানী (রাহ.) পবিত্র হাদিস শরীফের দরস দান করেন।
কুতবে আলম মাদানী (রাহ.) মারকাযিয়া মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে আসাম প্রদেশের কউমী মাদ্রাসা সমূহ সমন্বিত একটি শিক্ষাবোর্ড গঠন করেন। বাংলাদেশের প্রাচীনতম এই বোর্ড ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লিম’ নামে বর্তমানে খ্যাত। ১৯৪৭ ঈ. কায়িদুল উলামা-শাইখুল মাশারিখ হাফিয মাওলানা আব্দুল করিম শাইখে কৌড়িয়া (রাহ.) এই বোর্ডের সভাপতি মনোনিত হন। ২০০১ ঈ. মৃত্যু অবধি যোগ্যতা, সততা ও দক্ষতার সাথে সুষ্ঠু ভাবে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে দেশের সর্বত্র মাদ্রাসা স্থাপিত হচ্ছে।
১৮৯৮ ঈ. উমরগঞ্জ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান (রাহ.) এর শিষ্য, খিলাফত আন্দোলনের কর্মী, মাওলানা ইবরাহীম তশনা (রাহ.) সর্বপ্রথম দেশে ইসলামী জলসার প্রচলন করেন। বর্তমানে বিভিন্ন নাম ধারণ করে সেই ইসলামী জলসা উদযাপন করা হচ্ছে।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।