ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক
৫৫ ‘ব্ল্যাক স্পটে’ দুর্ঘটনার ঝুঁকি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২৩, ৪:৩০:২২ অপরাহ্ন
![<span style='color:#000;font-size:18px;'>ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক</span><br/> ৫৫ ‘ব্ল্যাক স্পটে’ দুর্ঘটনার ঝুঁকি <span style='color:#000;font-size:18px;'>ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক</span><br/> ৫৫ ‘ব্ল্যাক স্পটে’ দুর্ঘটনার ঝুঁকি](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2023/03/5-768x493.jpg)
ইউনুছ চৌধুরী
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সিলেট বিভাগীয় অংশের ৫৫ ব্ল্যাক স্পটে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। রাস্তার বাঁক, সড়কের পাশে গাছপালা বা স্থাপনায় দৃষ্টিসীমায় প্রতিবন্ধকতা, হাটবাজার, সড়কের কম প্রশস্ততা, দুর্ঘটনার সংখ্যা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে এসব ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ।
এসব ব্ল্যাক স্পটের কারণে এ মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মহাসড়কের সিলেট অংশে ২০২১ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৮৫টি। কিন্তু, ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১২টি। অর্থাৎ এক বছরে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৭টি। কেবল দুর্ঘটনাই বাড়েনি, বেড়েছে প্রাণহানিও। এ সড়কে ২০২১ সালে ১০২ জনের প্রাণহানি হলেও ২০২২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৩ জনে। আগের বছরের চেয়ে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ২১।
হাইওয়ে পুলিশ সিলেট রিজিওনের পুলিশ সুপার মো: শহীদ উল্যাহ সিলেটের ডাককে জানান, এ মহাসড়কের সিলেট-হবিগঞ্জ অংশে ৫৫টি ব্ল্যাক স্পটের মধ্যে সিলেট-শেরপুর অংশে এরই মধ্যে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে দক্ষিণ সুরমার তেতলী, লালাবাজার ফাঁসির গাছ, রশিদপুর, নাজিরবাজার, ওসমানীনগর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম-কশেরতল, গোয়ালাবাজার-গয়নাঘাট, ১৯ মাইল থেকে বুরুঙ্গা রাস্তার মুখ, নিরাইয়ার ব্রিজ, কাগজপুর, বেগমপুর বাজার, ফকিরাবাদ, ভাঙ্গা (গজিয়া), সাদিপুর ব্রিজ থেকে টোল প্লাজার মধ্যবর্তী স্থান উল্লেখযোগ্য ব্ল্যাক স্পট।
হাইওয়ে পুলিশ, সিলেট রিজিওনের পুলিশ সুপার মো: শহীদ উল্যাহ আরো বলেন, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের অধিকাংশ স্থানে রোড মার্কিং নেই। বিধান না থাকলেও এ মহাসড়কের স্থানে স্থানে স্পিডব্রেকারের ছড়াছড়ি। জরিমানা করেও মহাসড়কে অটোরিক্সা চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর পাশাপাশি চালকরা বিশ্রাম না নিয়েই চালাচ্ছে যানবাহন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে চালক সিলেট থেকে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা যাচ্ছে, ফিরতি হিসেবে সে-ই আবার ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে সিলেট আসছে। বিশ্রাম না নেওয়ায় অনেক চালক ঘুমিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেকে অবলীলায় ডান দিক থেকে চলে যাচ্ছে বামদিকে-এ কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট)-এর এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো: সাইফুন নেওয়াজ জানান, বিপজ্জনক বাঁকের পাশাপাশি রোড মার্কিংয়ের অভাব, ফিডার রোড (পার্শ্ব রাস্তা) এবং সড়কে অটোরিক্সার দাপট-এ মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার মূল কারণ।
সোহাগ পরিবহনের সাবেক ড্রাইভার ও সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম জানান, সিলেট-ঢাকা মহাড়কে পৃথক কোন লেন নেই। একটিমাত্র রাস্তা দিয়ে গাড়ি আসা-যাওয়া করে। পাশাপাশি এ মহাসড়ক অনেকটা অপ্রশস্ত। আগের তুলনায় রাস্তায় যানবাহন কয়েকগুণ বাড়লেও বাড়েনি রাস্তার প্রশস্ততা।
সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা জানান, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মূলত ওভারটেকিং, ওভার লোড, ওভার স্পীড ও ওভার কনফিডেন্স দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনারোধে সচেতনতার পাশাপাশি সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ও ট্রাফিক আইন মেনে চলার তাগিদ দেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
সড়ক বিভাগ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প চলমান। ফলে এমনিতেই মোড়গুলো আর থাকবে না। তবুও বিপজ্জনক জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হবে বলে জানান তিনি।
কেস স্টাডি : গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজার গয়নাঘাট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী জাহেদ আহমদ (৩৫) ও রেদওয়ান হোসেন (২৬) এর মোটরসাইকেলের সাথে একটি দ্রুতগতির বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ফলে ঘটনাস্থলেই জাহেদ আহমদ ও হাসপাতালে নেবার পথে রেদওয়ানের মৃত্যু হয়।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, নিহত জাহেদের বিয়ের তারিখ নির্ধারিত ছিল ৩ মার্চ। কিন্তু, বিয়ের পিঁড়িতে বসার ৫ দিন আগেই সড়কে প্রাণ হারান জাহেদ।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গয়নাঘাট ব্ল্যাক স্পট এলাকায় ২০২২ সালের ১৬ মে দ্রুত গতির একটি বাস একটি মোরসাইকেলকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা দেয়। ফলে মোটরসাইকেল আরোহী আব্দুল্লাহ আল মামুন হাওলাদার (২৫) ঘটনাস্থলেই মারা যান। অপর আরোহী মিরাজ হোসেন (৩০) গুরুতর আহত হন।
এদিকে, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কুরুয়াবাজারের সোয়ারগাঁও এলাকায় কাভার্ড ভ্যানের চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী যুবক এমাদ আহমদ (৩৫) নিহত হয়। হাইওয়ে পুলিশ একটি সিএনজি অটোরিক্সাকে থামার জন্য ইশারা করে। কিন্তু, সিএনজি অটোরিক্সাটি সেখান থেকে দ্রুত পালাতে গিয়ে এমাদের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। সিএনজির ধাক্কায় এমাদ মোটরসাইকেল নিয়ে পড়ে গেলে একটি কাভার্ড ভ্যান এসে তাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। নিহত এমাদ ছিলেন গোয়ালাবাজারের ব্যবসায়ী ও এক শিশু কন্যার জনক।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি গোয়ালাবাজার-গয়নাঘাট স্থানে মোটরসাইকেলে দ্রুতগতির বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক নিহত হয়।
এদিকে, নিরাইয়ার ব্রিজ এলাকায় গত ১৬ অক্টোবর মাইক্রোবাস খাদে পড়ে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ২ জন নিহত হন। এছাড়া, কাগজপুরে স্কুল ছাত্রী বৃষ্টি দাশ(১২) এবং বেগমপুর এলাকায় পথচারী হেকিম আলী(৪৫) বাস চাপায় নিহত হয়েছেন। দক্ষিণ সুরমার তেতলী এলাকায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাস ও প্রাইভেট কারের সংঘর্ষে এক শিশু ও কার চালক নিহত হয়। এছাড়া ১৪ জানুয়ারি পিকআপ ও সিএনজির দুর্ঘটনায় সিএনজি চালক ও এক যাত্রী নিহত হয়েছেন। এসব এলাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয় বাসিন্দা কয়েছ আহমদ জানিয়েছেন।
বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা : ২০২২ সালে দুর্ঘটনায় পতিত যানবাহনের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে মোটরসাইকেল। এসময়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ১৫৪টি দুর্ঘটনার মধ্যে বাস ২৮টি, ট্রাক, কার্ভাড ভ্যান দুর্ঘটনায় পড়ে ৩৯টি, পিকআপ-মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়ে ৩৫টি, করিমন-নসিমন-ভটভটি দুর্ঘটনা ঘটে ২৩টি এবং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে ২৯টি। যদিও ২০২১ সালে মোটরসাইকলে দুর্ঘটনা ছিল ১৫টি। সেই তুলনায় ২০২২ সালে মোটরসাইকলে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৪টি।
গোয়ালাবাজারের ব্যবসায়ী সেজুল আহমদ(৩৪) বলেন, যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে মহাসড়কের সিলেট-শেরপুর অংশে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।
ওসমানীনগর থেকে নির্বাচিত সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য আব্দুল হামিদ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানচলাচলে কোন শৃঙ্খলা নেই উল্লেখ করে বলেন, প্রচন্ড গতিবেগে বাসগুলো ছুটে চলে। এই গতিতেই তারা একটি অপরটিকে ওভারটেক করছে। ফলে ছোট গাড়িগুলো তাদের চোখেই পড়ে না। গাড়িগুলোর ফিটনেস, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক আছে কিনা বোঝার উপায় নেই। এই সড়কে মানুষ নিরাপত্তাহীনতা নিয়েই চলাচল করেন। তিনি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মহাসড়কে ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে অনুসরণের দাবি জানান। তিনি মোরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট না থাকলে জরিমানার পরিবর্তে তাদের নগদে হেলমেট ক্রয় করে মাথায় দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।
সচেতনতা কর্মসূচি: মহাসড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিধানে অভিযান, ওভার স্পিড যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থাসহ নির্ধারিত কার্যক্রমের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং কার্যক্রম, চালক ও চালক সমিতির সাথে সভা, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক সভা-লিফলেট বিতরণ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা, মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠা অবৈধ হাট বাজার উচ্ছেদ, হাইড্রোলিক হর্ণ অপসারণসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা।
এদিকে, শেরপুর হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ পরিমল চন্দ্র দেব জানান, মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। অনেক সময় পুলিশ সদস্যরা প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে পারেন না।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালক মো. শহিদুল আজম জানান, তাদের লোকবল খুবই কম। তারপরও তারা চালকদের তথ্য সংগ্রহ করছেন। মহাসড়কে তারা পুলিশের সহায়তায় অভিযান চালাবেন বলে জানান তিনি।