মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসন সার্ভিস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মার্চ ২০২৩, ৩:৫৯:০৪ অপরাহ্ন
মো. আতাউল গনি
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ও নেতৃত্বে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে অংশগ্রহণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধ অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে সশস্ত্র পেশাজীবি যথা– সেনা, বিমান, নৌ, পুলিশ, ইপিআর ও আনসার সদস্যদের অবদান ও বীরত্বগাথা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা। এছাড়া শিল্পী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের অবদানের কথাও দেশবাসী সম্যকভাবে অবহিত। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামরিক পেশাজীবীদের মধ্যে প্রশাসন সার্ভিসের অবদান ও গুরুত্ব এখনো বহুলাংশে অনালোচিত রয়ে গেছে।
১৯৪৭ হতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসককর্তৃক বাঙালিদেরকে শোষণ ও নির্যাতনের ইতিহাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ বছরব্যাপী ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি)-এর অফিসারগণ ছিলেন তাদের সময়ের সবচেয়ে কৃতী ও মেধাবী শিক্ষার্থী। তৎকালীন বাঙালি সিএসপি অফিসারগণ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালি শোষণের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাই বাঙালি হিসাবে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন সংগ্রমের প্রতি তাদের ছিল আন্তরিক সমর্থন।
১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সাথে সাথে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলা ও মহকুমার বাঙালি জেলা প্রশাসক ও মহকুমা প্রশাসক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি তৎক্ষণাৎ প্রকাশ্য আনুগত্য প্রকাশ করেন। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় সর্বাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাদের অনেকেই নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের অস্ত্রাগার খুলে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাগণকে লিখিতভাবে নির্দেশ প্রদান করেন।
পাবনা জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরুল কাদের খান অস্ত্রাগার খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অস্ত্র প্রদান করেই দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি নিজে অন্যদের সাথে নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিরোধ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। পাবনা জেলা শহর দখল করতে গিয়ে তার নেত্বতে প্রতিরোধযুদ্ধে কিছুসংখ্যক হানাদার সৈন্য প্রাণ হারায়। সর্বপ্রথম তিনি পাবনা জেলায় তার স্বাক্ষরযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের সিল ব্যবহার করেন। একই সাথে খান সেনাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য তিনি তার নাম থেকে খান উপাধী মুছে ফেলেন। যাইহোক পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে গেলে এপ্রিল মাসের শুরুতে তিনি পাবনার কোষাগার ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ ও সরকারি গাড়িসহ কুষ্টিয়া হয়ে প্রথমে চুয়াডাঙ্গা ও পরবর্তীতে মেহেরপুর চলে যান। উল্লেখ্য, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নিলে তিনি তার সাথে নেয়া সকল অর্থ মুজিবনগর সরকারের তহবিলে জমা প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইতোমধ্যে তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) তৌফিক-ই- ইলাহী চৌধুরী (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা) পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে আতনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে তিনি সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন এবং বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম উপাধি লাভ করেন।
অন্যদিকে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম (পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা) তার জেলার অস্ত্রভা-ার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেন। ট্রেজারির টাকাসহ বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধকে সাংগঠনিক রূপ দেয়ার প্রয়াস চালান। মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিযুক্ত করা হয়। রাজশাহীর প্রাক্তন জেলা প্রশাসক ও তৎকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা খন্দকার আসাদুজ্জামান (প্রয়াত জাতীয় সংসদ সদস্য) সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি তার নিজ জেলা টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকারের সচিব হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিএসপি কর্মকর্তা রাঙামাটি জেলার এডিসি সৈয়দ আব্দুস সামাদ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাবেক একান্ত সচিব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব) সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিএসপি কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক খান মুজিবনগর সরকারে যোগদান করে তথ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক আকবর আলি খান (সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তত্তাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) হবিগঞ্জের অস্ত্রাগার খুলে মুক্তিযোদ্ধোদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া নাটোর, মাগুরা, বগুড়া, কুড়িগ্রাম ও ঝিনাইদহের মহকুমা প্রশাসকগণ সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মশিউর রহমান (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা), সা’দত হুসাইন (সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির চেয়ারম্যান), কামাল সিদ্দিকী (প্রাক্তন মুখ্য সচিব) সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও মুজিবনগর সরকারের অধীনে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তা এম. রুহুল কুদ্দুসও মুজিবনগর সরকারে যোগদান করে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ এম এ মুহিত (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী) এবং হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর (সাবেক স্পিকার) মতো প্রশাসন সার্ভিসের যে সকল বাঙালি সদস্য বিভিন্ন দেশের পাকিস্তান দূতাবাসে বা আর্ন্তজাতিক সংস্থায় কর্মরত ছিলেন, তাদের অনেকেই পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং বর্হিবিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথিত অপরাধে সিএসপি ও ইপিসিএস মিলিয়ে প্রশাসন সার্ভিসের ৫৫ জন কর্মকর্তাকে পাকিস্তানি সামরিক আদালত চৌদ্দ বছর করে সশ্রম কারাদ- ও তাদের অর্ধেক সম্পতি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থানরত প্রশাসন সার্ভিসের কর্মকর্তা আইয়ুবুর রহমান, আ ন ম ইউসুফ, সৈয়দ রেজাউল হায়াত ও শাহ মোহাম্মদ ফরিদকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শেরেবাংলা নগরস্থ বন্দি শিবিরে আটক রাখে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক এ কে এম শামছুল হক, সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন, রাঙ্গামাটি সদরের মহকুমা প্রশাসক আব্দুল আলী, রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসন সার্ভিসের বেশ কয়েকজন সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বাঙালি সদস্য, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও দেশের ভেতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেছেন। অনুরুপভাবে প্রশাসন সার্ভিসের গুটিকয়েক সদস্য ব্যতীত অন্য সকল বাঙালি কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রেখেছেন।
সিএসপি কর্মকর্তাগণ উঁচু সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও নিশ্চিত জীবনের মোহ ত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রকৃত প্রস্তাবে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন সার্ভিসের গোড়াপত্তন করেন। স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রান্ত হলেও মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসন সার্ভিসের ভূমিকা নিয়ে সামগ্রিক কোনো গবেষণা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের কারও কারও আত্মজীবনী, সাক্ষাৎকার ব্যতীত এসব বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে বৃহত্তর জনসমাজে তেমন কোনো আলোচনা শোনা যায় না। এমনকি প্রশাসন সার্ভিসের অনেক সদস্যের কাছেও মুক্তিযুদ্ধে তাদের পূর্বসুরীদের অবদান ও বাংলাদেশ প্রশাসন সার্ভিসের জন্মকথা এখনো অজানা।
আমি টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন একখ- জায়গাকে মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসন সার্ভিসের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জনসেবা চত্বর’ নামে নামকরণ করা হয়। জনসেবা চত্বরে মূল মঞ্চটি টাঙ্গাইল জেলার কৃতিসন্তান কুমিল্লা জেলার শহীদ জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম শামছুল হকের নামে করা হয়। মঞ্চের ডান পাশে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাম পাশে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সুদৃশ্য ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। চত্বরের প্রবেশ তোরণটি প্রশাসন সার্ভিসের একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং বহির্গমন তোরণটি টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আসাদুজ্জামানের নামে নামকরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
মার্চ মাস আমাদের মহান স্বাধীনতার মাস। কোটি মানুষের ত্যাগ ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা এ স্বাধীনতা পেয়েছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রভূত্ববাদী ও কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনের বিলুপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করে জনবান্ধব প্রশাসন সার্ভিসের অভ্যুদয় ঘটেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন সার্ভিসের প্রতিটি সদস্যের অন্তর; জনসেবা প্রদানের এক একটি চত্বর। মহান স্বাধীনতার মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ শহীদ সকলের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা। একই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন সার্ভিসের গোড়াপত্তনকারী অগ্রজদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র কৃতজ্ঞতা।
লেখক : যুগ্ম সচিব