বঙ্গবন্ধুর কারাগারের দিনগুলি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মার্চ ২০২৩, ৪:০১:১৫ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন মানুষ। বাংলাদেশের একটি গ্রাম থেকে আর দশটি পরিবারের মতই একটি পরিবার থেকেই তিনি মহানায়কের পর্যায়ে চলে এসেছেন। কিন্তু এসবের উর্ধ্বেও বঙ্গবন্ধু একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে রয়েছে তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষের মুক্তির জন্য তার সংগ্রামী ও বিপ্লবী ভূমিকা। এমন বিশ্বজোড়া খ্যাতি পৃথিবীর বুকে কয়জন রাজনীতিবিদের জীবনে অর্জিত হয়েছে। ষাটের দশকের শেষের দিকে ল-নের গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার মুকুটহীন স¤্রাট। যুদ্ধ সংকটে জর্জরিত ব্রিটেনবাসীর কাছে উইন্সটন চার্চিল। নায়কহীন ফরাসিদের কাছে দ্যাগল। ইন্দোনেশিয়ার কাছে সুকর্ণ যা ছিলেন দুর্ভাগা বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মুক্তির উইল প্রতীক একটি জীবন্ত আদর্শ।
শৈশবে মুজিব ছিলেন যেমন দুর্বার তেমনি ছিলেন দুর্ধর্ষ। তাঁর স্কুল জীবনেই এক দুঃসাহসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তার সেই বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রবাদ আছে গধহ ষরাব রহ ফববফং ধহফ হড়ঃ রহ ুবধৎং. কবির ভাষায়-
জীবনের পরিমাপ দৈর্ঘ্যে প্রস্থে নয়,
কর্মের মাধ্যমে তার মাপজোক হয়।
জীবনে অনেক কিছু ফিরে আসে, ফিরিয়ে আনা যায়, কিন্তু সময় ফিরিয়ে আনা যায় না। অমীত শক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর রক্তে বহমান ছিল মাটিকে ভালোবাসা। এই মাটির ডাকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাকে মাত্র চুয়ান্ন বৎসরের জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগার থেকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় কৈশোর জীবনে চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে পুলিশ কর্তৃক সাতদিনের জন্য কারাগারে আবদ্ধ হন। এই প্রথম তিনি সা¤্রাজ্যবাদ শক্তির শিকারে পরিণত হন। এই হলো তার কারাগার জীবনের সূচনা।
১৯৪৮ সালের ১১-১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচদিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর কারাগারে গিয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ যাত্রায় ১৩২ দিন কারাবাস হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গমন। ৮০ দিন পর মুক্তি পান একই বছরের ২৮ জুন। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২৭ দিন কারাবাস করেন। ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন কারাবাসে থাকেন। ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ৭৮৭ দিন কারাগারে দুঃসহ জীবন কাটে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। এ যাত্রায় তিনি ২০৬ দিন কারাবাসী ছিলেন। ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আয়ূব খাঁন মার্শাল ল’ জারির পর বঙ্গবন্ধুকে ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। এই সময় টানা এক হাজার ১৫৩ দিন কারাগারে দুঃসহ জীবন কাটাতে হয়। ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় গ্রেফতার একই বছর ১৮ জুন মুক্তি পান। এ দফায় কারাবাস ১৫৮ দিন। ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে ৬৬৫ দিন কারাগারে কাটান। ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রচার অভিযানে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাবাসী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। এ সময়ে ১ হাজার ২১ দিন কারাবাস করেন। একই বছর পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ৬৯ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী মাঠে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। ২৬ মার্চের প্রথম লগ্নেই বাঙালির অবিসম্বাদিত প্রাণপ্রিয় মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। পাকবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানম-ি বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে বন্দী অবস্থায় সামরিক আইনের বিচারে তিনি ফাঁসির আদেশে দ-িত হন। এ দফায় তিনি ২৮৮ দিন কারাবন্দী ছিলেন।
পরিশেষে বলতে চাই- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনকে জোসেফ স্টালিন, সানইয়াৎ সেন, ড. হো চী মিন এর সঙ্গে তুলনা করা চলে। তুলনা করা চলে কঙ্গোর লৌহমানব লুবুন্ডা, কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং আলজেরিয়ার বেন বেল্লার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আজ শুধু একজন ব্যক্তি নন, শুধু একটি জাতির পিতাই কেবল নন বঙ্গবন্ধু বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের চেতনার প্রতীক, তাঁর সমগ্র সত্তাটি আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত।
লেখক: কলামিস্ট