মৃৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মার্চ ২০২৩, ৪:১৮:৪৩ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ শাহজাহান :
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ। বেঁচে থাকলে এ বছর মহান নেতা মুজিবের ১০৩ বছর পূর্ণ হতো। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাঙালির আদরের দুলাল শেখ মুজিব। ছোট দেশের জাতির পিতা শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে বিশ্বনেতায় পরিণত হন। বলতে গেলে ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। শেখ মুজিবের মধ্যে এমনসব রাজনৈতিক গুণাবলী ছিল, যা সচরাচর কোনো রাজনীতিবিদের মধ্যে দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতিশয় দক্ষ সংগঠক, অনলবর্ষী বক্তা, অসামান্য জনপ্রিয়, অসীম সাহসে বলীয়ান একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা। মুজিবের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কোনো তুলনা হয় না। বিবিসির বিশ্বব্যাপী শ্রোতা জরিপে ২০০৪ সালে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃত হন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একদিন যেমন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, তেমনি মহান নেতা মুজিবও ভাবীকালের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পাবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের ‘সেল’ এর পাশে কবর খোঁড়া হয়। সেই ন’মাস পাকিস্তানী চক্র মুজিবের মুখ দিয়ে একটি কথাও বের করতে পারেনি। মুজিবের এক কথা ‘আমাকে আমার জনগণের কাছে যেতে হবে।’ ক্ষমতার পালাবদলে জে. ইয়াহিয়া বিদায় নিলো। প্রেসিডেন্ট পদ দখল করে জেড এ ভুট্টো দ্বারস্থ হন মুজিবের। বাংলার সাথে ‘কনফেডারেশন’-এর জন্য ভুট্টোর কি কাকুতি-মিনতি! এদিকে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধু তার কিছুই জানতেন না। পাকিস্তানী শাসকচক্র বাংলার নেতাকে সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু ভুট্টোকে কোনো প্রতিশ্রুতিই দেননি মুজিব। সেই একই কথা মুজিবের। ভুট্টোকে তিনি স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন, ‘আমার জনগণ কি চায় আমাকে তা জানতে হবে।’ এভাবে দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, আপোসহীনতা এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের দাবির প্রতি বিশ্বস্ত থাকাই ছিল মুজিব নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য।
১৯৬৯ এবং ১৯৭১ দু’বারই পাকিস্তানি শাসক ও শোসকচক্র সাজানো রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যার চক্রান্ত করে। কিন্তু শেখ মুজিব ক্ষমতা ও আপোসের পরিবর্তে ফাঁসির দড়িকেই বেছে নেন। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেট থেকেই সামরিক চক্র গ্রেফতার করে। সামরিক বাহিনীর গাড়িতে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। অকুতভয় শেখ মুজিব জেলগেটে একমুঠো মাটি কপালে ছুঁয়ে শুধু এই কামনা করেন, ‘এদেশেতে জন্ম আমার, এদেশেই যেনো মৃত্যু হয়।’ একইভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়। তখনো তিনি বলেন, ‘ফাঁসির পরে তোমরা আমার লাশটা বাংলায় পাঠিয়ে দিও।’ যে মানুষ মরতে চায়, তাকে কেউ মারতে পারে না। ’৭১-এর ৭ মার্চ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ এভাবেই শেখ মুজিব মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন।
রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও গবেষক মোনায়েম সরকার রচিত দুই খণ্ডের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ গ্রন্থে ১৯৬৮ সালে জেল থেকে গভীর রাতে সামরিক যানে ওঠার আগে মুজিব কি বলেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে। প্রথম খণ্ডের ৩৪৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “… শেখ মুজিব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘বুঝলাম, সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।’ বিদায়ের পূর্বে কারাকক্ষের সঙ্গী আব্দুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বন্ধু! বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানি না, কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাবে। হয়তো বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাওয়ার সময় আপনাকে শুধু একটি কথা বলে গেলাম, বাংলাদেশের সাথে আমি কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, কোনোদিন করবো না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইল। এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য।… শেখ মুজিবের চোখ দিয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।” এই ছিলেন শেখ মুজিব। স্বাধীন বাংলাদেশ হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। মুজিব তাঁর সমগ্র জীবন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লালন করেছেন। আর এই লক্ষ্য নিয়েই ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে গেছেন, স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু মুজিবই যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলতে চাই। কোনো দেশের মুক্তিসংগ্রাম একদিনে হয় না। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আর যে কেউ ইচ্ছা করলেই স্বাধীনতার ঘোষনা করতে পারেন না। স্বাধীনতা ঘোষণা করার এখতিয়ার থাকতে হয়। ’৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ মানুষ ভোট দিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলার অধিকার একমাত্র শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকেই দিয়েছে। কাজেই একাত্তরে বাংলার মানুষ, স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার একমাত্র শেখ মুজিবকেই দিয়েছে, অন্য কাউকে নয়। তাছাড়া কোনো অপরিচিত ব্যক্তির কথায়, ডাকে বা আহবানে জনগণ জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় না। একাত্তরের ১৫ মার্চ বিখ্যাত টাইম সাময়িকী লিখেছে, “আসন্ন বিভক্তি অর্থাৎ পাকিস্তানকে দু’টি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করার পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন, তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিব। গত সপ্তাহে ঢাকায় টাইম-এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে মুজিব বলেন, “পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোনো আশা নেই।” ২৭ মার্চ একাত্তর বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রথম পাতায় লেখা হয়, ‘শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। একাত্তরের ৫ এপ্রিল আমেরিকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী নিউজইউক-এ প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছেপে বলা হয়, ‘২৬ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’ একই প্রতিবেদনে শেখ মুজিবকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামী-দামী অসংখ্য পত্রিকা-ম্যাগাজিনে ২৬ মার্চ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর প্রকাশিত হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক সিরিলডন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেন, ‘মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য বর্তমানের চমকপ্রদ নাটকীয় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের একদিনের ইতিহাস নয়, বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি তার লক্ষ্য ছিল।’ (সোহরাব হাসানের শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়া, পৃষ্ঠা ১৭৪)। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রশাসনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ গ্রন্থে লিখেছেন, “৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকারি তরঙ্গের (ওয়েভ লেংনথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।” ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ভাষণের পর ৯ মার্চ লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফ লিখে, ‘মনে হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’ পাকিস্তানের সামরিক চিন্তাবিদ জেনারেল কামাল মতিন উদ্দিন তাঁর ‘দ্য ট্র্যাজেডি অব এরর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইধহমষধফবংয যধফ ারৎঃঁধষষু পড়সব রহ ঃড় নবরহম ড়হ গধৎপয ৭, ১৯৭১’। অর্থাৎ ‘প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর ৭ মার্চই বাংলাদেশ জন্ম লাভ করেছে। (১২ মার্চ ২০০৮, দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এম আবদুল হাফিজের কলাম থেকে)।
একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলার মানুষ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশ নয়, মুজিবের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ঐ সময় বিদেশী পত্রিকায় লেখা হয়, ‘মুজিবের ৩২ নম্বরের ধানমন্ডির বাড়িকে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটের সাথে তুলনা করা হয়। অর্থাৎ বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর মতো ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে মুজিব ঐ ২৫ দিন বাংলাদেশ শাসন করছেন। সাংবাদিকরা তখন লিখেন, ুঅষষ ৎড়ধফং ষবধফ ঃড় ৩২ ঘড়.” সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান-এর ‘১৯৭১Ñ আমেরিকার গোপন দলিল’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশের জনক।’ এতে বলা হয়, ’৭১-এর ২৬ মার্চ ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৩টা ৩ মিনিট থেকে ৩টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত পররাষ্ট্র সচিব ড. হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে সিআইএ’র পরিচালক রিচার্ড হেলমস জানান, ‘মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন এবং রাত ১টায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ (পৃষ্ঠা ৭৮) একই গ্রন্থে ১৯৭২-এর ২১ ডিসেম্বর সিআইএ’র গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনে মুজিবকে বাংলাদেশের জনক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। (পৃষ্ঠা ২৬)। এই গ্রন্থে একাত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি ড. কিসিঞ্জারের দুই পৃষ্ঠার টাইপকৃত স্মারকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতেই শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই বার্তা পায় যে, তাঁর দাবি পূরণ না হলে তিনি একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং সে ক্ষেত্রে গৃহযুদ্ধ এড়াতে মুজিব যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশী কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।’ (পৃষ্ঠা ৫৭)
গত পাঁচ দশকে দেশ-বিদেশের লেখা পত্রপত্রিকা-গ্রন্থ থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিতÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই হচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা এবং এই দেশটির প্রতিষ্ঠাতা। নিউজ উইক মহান নেতা মুজিবকে যথার্থভাবেই ‘রাজনীতির কবি’ বালে স্বীকৃতি দিয়েছে। জন্মদিনে বাংলা ও বাঙালির প্রিয় নেতা, ইতিহাসের মহানায়ক, রাজনীতির কবি, বাংলার মানুষের অভিভাবক, মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা