মাহে রমজানের ফজিলত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মার্চ ২০২৩, ২:৪০:৫১ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
হে ঈমানদারগণ। তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর- যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারা : আয়াত- ১৮৩)। উক্ত আয়াতে মুমিনদের উপর রোজা ফরজ হওয়ার বিধান ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেই সাথে রমজানের রোজার উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, যে কেউ রমজানের রোজা সঠিকভাবে পালন করবে সে মুত্তাকী হয়ে যাবে। আল্লাহকে ভয় করে যে সকল প্রকার অপকর্ম ছেড়ে দেয় সেই তো হচ্ছে মুত্তাকী। মুত্তাকী হওয়ার অতি উৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে মাহে রমজানের রোজা। অগণিত হাদীসে মাহে রমজানের রোজার ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। মাহে রমজানের রোজার ফজিলত বিষয়ক কয়েকখানা হাদীস নি¤েœ উপস্থাপন করা হল :
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘যখন রমজান মাস আসে তখন আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়। অপর বর্ণনায় রয়েছে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, আর শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়। অপর বর্ণনায় আছে, রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’ (বুখারী ১ম খ-: পৃষ্ঠা- ২৫৫, মুসলিম ১ম খ-: পৃষ্ঠা- ৩৪৬)।
(২) হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘জান্নাতে আটটি দরজা রয়েছে। তার মধ্যে একটি দরজার নাম বাইয়্যান। রোজাদারেরা ছাড়া ওই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না’ (বুখারী ১ম খ-: পৃষ্ঠা-২৫৪, মুসলিম ১ম খ-: পৃষ্ঠা-৩৬৪)।
(৩) হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, যে ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা রাখবে তার পূর্বের গুণাহসমূহ ক্ষমা করা হবে এবং যে ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের নিয়তে রমজানের রাত ইবাদতে কাটাবে (তারাবীহ আদায় করবে) তার পূর্বের গুণাহসমূহ ক্ষমা করা হবে এবং যে ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের নিয়তে কদরের রাত ইবাদতে কাটাবে তার পূর্বের গুণাহসমূহ ক্ষমা করা হবে’ (বুখারী ১ম খ-: পৃষ্ঠা- ২৫৫, ২৭০, মিশকাত: পৃষ্ঠা-১৭৩)।
(৪) হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন মানব সন্তানের প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহপাক বলেন, রোজা ছাড়া। কেননা রোজা আমারই জন্য এবং আমিই উহার প্রতিফল দান করব। কারণ সে আমার জন্যই আপন প্রবৃত্তি ও খানাপিনার জিনিস ত্যাগ করে। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি তার ইফতারের সময় অপরটি জান্নাতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভের সময়। নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের খুশবু অপেক্ষাও অধিক সুগন্ধময়। রোজা হচ্ছে মানুষের জন্য জাহান্নাম হতে রক্ষার ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারও রোজার দিন আসে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার’ (বুখারী ও মুসলিম)।
(৫) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘রমজানের জন্য জান্নাত সাজান হয়ে থাকে বছরের প্রথম হতে পরবর্তী বছর পর্যন্ত। তিনি বলেন, যখন রমজান মাসের প্রথম দিন উপস্থিত হয়, জান্নাতে গাছের পাতা হতে আরশের নীচে বড় বড় চোখ বিশিষ্ট হুরদের প্রতি এক হাওয়া প্রবাহিত হয়। তখন তারা বলেন, হে প্রভু! আপনার বান্দাদের মধ্য হতে আমাদের জন্য এমন স্বামী সকল নির্দিষ্ট করুন, যাদের দেখে আমাদের চোখ জুড়াবে এবং আমাদের দেখে তাদের চোখ জুড়াবে’ (বায়হাকী, মিশকাত: পৃষ্ঠা- ১৭৪)।
(৬) হযরত সালমান ফারসী (রা:) বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন, একবার রাসূল (সা:) আমাদেরকে শা’বান মাসের শেষ তারিখে ভাষণ দিলেন এবং বললেন, হে মানবসকল! তোমাদের প্রতি ছায়া বিস্তার করেছে একটি মহান মাস, মোবারক মাস, এমন মাস যাতে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। আল্লাহপাক রমজানের রোজাসমূহকে করেছেন তোমাদের ওপর ফরজ এবং রমজানের রাতে নামাজ পড়াকে করেছেন তোমাদের জন্য নফল। যে ব্যক্তি সে মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করল, সে ওই ব্যক্তির সমান হল, যে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে ওই ব্যক্তির সমান হল, যে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করল। রমজান মাস সবরের মাস আর সবরের সাওয়াব হল জান্নাত। রমজান সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা সেই মাস যাতে মুমিনের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য তার গুণাহসমূহের ক্ষমা স্বরূপ হবে এবং জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার সাওয়াব হবে সেই রোজাদার ব্যক্তির সমান অথচ রোজাদারের সাওয়াবও কম হবে না। সাহাবীগণ বলেন, আমরা আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ্য রাখে না যা দিয়ে রোজাদারকে ইফতার করাতে পারে? রাসূল (সা:) বললেন, আল্লাহ পাক এ সাওয়াব দান করবেন, যে রোজাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দিয়ে অথবা একটি খেজুর দিয়ে অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে। (অতি সামান্য খাদ্যবস্তু দ্বারা ইফতার করালেও উক্ত মর্যাদার অধিকারী হবে) আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে খাওয়ায়, আল্লাহপাক তাকে আমার ‘হাউজে কাউসার’ হতে পানীয় পান করাবেন যার পর পুনরায় সে তৃষ্ণার্থ হবে না জান্নাতে প্রবেশ পর্যন্ত। রমজান এমন মাস যার প্রথম দিক রহমতের, মধ্যম দিক মাগফিরাতের আর শেষ দিক হচ্ছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির। আর যে ব্যক্তি রমজান মাসে নিজের দাসদাসীদের প্রতি কার্যভার লাঘব করে দিবে আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দান করবেন’ (বায়হাকী, মিশকাত: পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৪)।
(৭) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘রোজা এবং কুরআন আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলা খানা ও প্রবৃত্তি হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা হতে বাঁধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতএব, উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে’ (বায়হাকী)।
মাহে রমজান অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এ মাসেই মানবমুক্তির দর্পণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘রমজান মাস, ইহাতে মানুষের দিশারী এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন নাজিল হয়েছে’ (সূরা বাকারা: আয়াত-১৮৫)। মাহে রমজানের ‘লাইলাতুল কদরে’ মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি ইহা (কুরআন) নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে’ (সূরা কদর: আয়াত-১)। সেই লাইলাতুল কদরের অশেষ মহিমা বর্ণনা করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহরিন’ অর্থাৎ লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম (সূরা কদর: আয়াত-৩)। উক্ত আয়াতে লাইলাতুল কদরকে ‘হাজার মাস’ অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে। কিন্তু ‘কয় হাজার মাস’ অপেক্ষা উত্তম তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। আবার উক্ত আয়াতে ‘খাইরুন’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ব্যাকরণের ভাষায় ‘খাইরুন’ শব্দের কোনো সীমা শরহদ নেই। অর্থাৎ কয় হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম তার কোনো সীমা নেই। হাজার হাজার মাস, লক্ষ লক্ষ মাস, কোটি কোটি মাস, অসংখ্য- অগণিত মাস ইবাদত করে যে সাওয়াব পাওয়া যাবে, কদরের রাতে ইবাদত করে এর চেয়েও বেশি সাওয়াব পাওয়া যাবে। উক্ত আয়াতের সঠিক মর্ম মূলত: এটাই। এজন্য যারা লাইলাতুল কদরে ইবাদত থেকে বঞ্চিত হন তারা অত্যন্ত হতভাগ্য। হযরত আনাস (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘যে কদরের রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে সকল প্রকার কল্যাণ হতেই বঞ্চিত হয়েছে। আর সে রাত হতে বঞ্চিত হয় একমাত্র চিরবঞ্চিতরাই’ (ইবনে মাজাহ: পৃষ্ঠা-১১৯, মিশকাত: পৃষ্ঠা- ১৭৩)।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট