জনসংখ্যা ও আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মার্চ ২০২৩, ৩:০১:০৮ অপরাহ্ন
পারভেজ আলম
আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করছি যে দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১ হাজার ১১৯ জন মানুষের বসবাস। এ হিসেবে এটি পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে দেশের আভ্যন্তরীণ সম্পদের যোগানে খরা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। প্রতি বছর মোট জনসংখ্যার সাথে নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন তিরিশ লক্ষাধিক মানুষ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে বসতভিটা, চাষযোগ্য জমি, খাদ্য, পরিবেশ, বনজ ও খনিজ সম্পদের ওপর।
আশংকার বিষয় হল, অর্থনৈতিক কারণে দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে জনঘনত্ব বাড়ছে লাগামহীনভাবে। সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লাসহ বেশ কয়েকটি নগর এবং শহরে জনসংখ্যার চাপ অত্যাধিক। রাজধানী ঢাকা শহরেই প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। এই বাড়ন্ত জনঘনত্বের কারণে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে জনগণেরনূন্যতম নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জনঘনত্ব কমাতে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রসঙ্গ সবার আগে আসে তা হল, পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ। তবে পরিবার পরিকল্পনাকে এখন কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পন্থা হিসাবে দেখার উপায় নেই। একজন মায়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে তথা দুই গর্ভের মাঝে কমপক্ষে ২ বছরের বিরতি বা বিশ্রাম, অপুষ্টি থেকে রক্ষা ও সন্তান প্রসবে প্রয়োজনীয় শারীরিক শক্তির পুনঃসঞ্চয়, গর্ভধারণের জটিলতা কমিয়ে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি কমানোসহ ২০ বছরের নিচে এবং ৩৫ বছরের উপরে মহিলাদের অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ রোধ করতে পরিবার পরিকল্পনা অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
দেশের অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণকে বাধামুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করছি। সেক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনাও জরুরি। কারণ পরিকল্পিত গর্ভধারণ একজন নারীর বাড়ির বাইরে যোগাযোগ, পারিপার্শিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে একটি অসচ্ছল পরিবার হবে স্বাবলম্বী।
কিন্তু অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যান্য কারণে এদেশে পরিবার পরিকল্পনার প্রচারণা, বিশেষ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুমোদিত পদ্ধতির ব্যবহার এখনও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করেন না।
জন্ম বিরতিকরণ খাবার বড়ি, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন, কপার টি, লাইগেশন, চামড়ার নিচে বসিয়ে দেয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুল, কনডম এবং ভ্যাসেক্টমি গ্রহণ করার মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনার পরামর্শ দেওয়া হয়। সমস্যা হল, এ সকল পদ্ধতির মধ্যে কেবল কনডম ও ভ্যাসেক্টমি পুরুষের জন্য আর অনেক পুরুষ এসব ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে নারীরা কুসংস্কারে এবং পারিবারিক ও সামাজিক চাপে আচ্ছন্ন থেকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করতে দ্বিধায় ভোগেন। অনেকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীর পরামর্শ না মেনে পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে গিয়ে পার্শ প্রতিক্রিয়ার শিকার হন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরিবার পরিকল্পনায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সমান অংশগ্রহণ আবশ্যক।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েদের সংখ্যা বেশি যাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তুলনামূলক কম। এমন পরিবারের জন্য প্রয়োজন পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কীত সুপরামর্শ ও সঠিক উপকরণের সহজলভ্যতা।
আশার কথা, দেশে পরিবার পরিকল্পনার ধারণাকে জনপ্রিয় করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এগিয়ে এসেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া আরবান প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার প্রজেক্ট এবং আরবানপ্রাইমারী হেল্থ কেয়ারসার্ভিসেস ডেলিভারিপ্রজেক্টের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ধারাবাহিকতায় দেশের ১১টি সিটি কর্রপোরেশন এবং ১৩টি পৌরসভা এলাকায় ১৫ থেকে ৪৯ বয়সের দম্পতিদের, বিশেষ করে যারা অতি দরিদ্র বা স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী, তাদের আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় রংধনু-চিহ্নিত ৩৮টি মাতৃসদন, ১৫০টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৩০০টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকে উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন এবং দক্ষ সেবাপ্রদানকারীরা পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত পরামর্শ ও উপকরণের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজে এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। প্রকল্পভুক্ত প্রায় ৭০ শতাংশ উপযুক্ত বিবাহিত দম্পতি বর্তমানে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন যেখানে জাতীয় পর্যায়ে এই হার ৫৪ শতাংশের কাছাকাছি।
দেশে মোট প্রজনন হার ২ শতাংশে নামিয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ও মাতৃস্বাস্থ্য নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পের যে উদ্যোগ তা সফল করতে তথা সমাজে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার সুবিধা সম্পর্কে অবগত করতে সমাজের সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রকল্প ব্যবস্থাপক, পিএ-১, সীমান্তিক, সিলেট।