সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর খাদ্যগুদাম
‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র চাল কেলেংকারির অন্য মোড়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মার্চ ২০২৩, ৪:৩০:০৪ অপরাহ্ন
তদন্ত প্রতিবেদন জমা, ফেঁসে যাচ্ছেন ডিলাররা
নূর আহমদ
সুনামগঞ্জের মল্লিকপুরের খাদ্য গুদাম থেকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত কর্মসূচি ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র চাল বিতরণে অনিয়মের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। এতে নতুন মোড় নিয়েছে ঘটনার। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিলার পয়েন্ট পর্যন্ত সিদ্ধ চাল পৌঁছুলেও ডিলাররা ভোক্তাদের আতপ চাল দিয়েছেন। এমনকি তদন্ত কমিটি ৬১ জন ভোক্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ৫৫ জনকেই আতপ চাল দেয়া হয়েছে বলে সত্যতা পেয়েছে। এর আলোকে ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মতামত দিয়েছে কমিটি। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে মল্লিকপুরের খাদ্য গুদাম এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুমকে বাঁচাতে ডিলাররা নিজেরাই এবার ফেঁসে যাচ্ছেন। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নিলে তাদের ডিলারশিপ বাতিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
তখন যা ঘটেছিলো
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে খাদ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর খাদ্য গুদামে মজুদ থাকা প্রায় ৪শ’ টন সিদ্ধ চাল বেশি দামে বিক্রি করে কম দামে বাজার থেকে আতপ চাল কিনে সেটি ডিলারদের সরবরাহ করা হয়েছে এমন অভিযোগ উঠে। আর এই সিদ্ধ ও আতপ চালের চালাচালিতে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। অভিযোগ উঠে মল্লিকপুরের খাদ্য গুদাম এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুমই এর মূল হোতা। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত কর্মসূচি ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র চাল বিতরণের ঘটনায় গঠন করা হয় একটি তদন্ত কমিটি। শুরু থেকেই তদন্ত কমিটির কাজ শুরু করতে বিলম্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে। অভিযোগ উঠে ডিলার পয়েন্ট থেকে চাল বিলির পর তদন্তে নামে কমিটি। সাত কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও সর্বশেষ সরেজমিন তদন্ত শেষে গত ১৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে ডিলারদেরই দায়ী করা হয়েছে।
যেভাবে ফেঁসে যাচ্ছেন ডিলাররা
চলতি মাসের ১ তারিখে দৈনিক সিলেটের ডাক এর সাথে আলাপকালে গৌরারং ইউনিয়নের ডিলার মো: মনিরুল হক দাবি করেন, ৪৯০ বস্তা চাল পেয়েছেন তিনি। তার সবগুলো আতপ চাল। তার ট্যাগ অফিসার তাকে মনিটরিং করছেন নিয়মিত। ট্যাগ অফিসার উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রেজিয়া সুলতানা দাবি করেন, ডিলারের দোকানে গিয়ে আতপ চাল বিক্রি করতে দেখেছেন তিনি।
রঙ্গারচর ইউনিয়নের ডিলার নূরুজ্জামান জানিয়েছিলেন ৫৫৫ বস্তা চাল পেয়েছেন, সবই আতপ। তিনি বলেন, তার ট্যাগ অফিসার রঙ্গারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শারমিন সুলতানা মনিরা নিয়মিত আসেন। এ ব্যাপারে ট্যাগ অফিসার মনিরা বলেন, চালের বস্তা দেখেছেন, তবে আতপ না সিদ্ধ খেয়াল করেননি, বিষয়টি ভালো করে দেখবেন।
সুরমা ইউনিয়নের ডিলার ও উপজেলা ডিলার সমিতির সভাপতি এরন মিয়া জানিয়েছিলেন, ‘আতপ চালই পেয়েছি এবং তা বিক্রি করেছি’। এই ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো: আল আমিন জানান, আতপ চাল বিতরণ করা হয়েছে। ডিলাররা গণমাধ্যমে এমন তথ্য জানালেও পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির কাছে তারা সিদ্ধ চাল পেয়েছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে এই বক্তব্যে ডিলারগণ ও ভোক্তাদের বক্তব্যে মিল না থাকায় ডিলাররা নিজেরাই এখন ফেঁসে যাচ্ছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা
ডিলাররা গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য পাল্টালেও অনেক ট্যাগ অফিসার তদন্ত কমিটির কাছে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন। তদন্ত কমিটির কাছে দেয়া ৮ জন ট্যাগ অফিসারের মধ্যে ৪ জন বস্তার মধ্যে আতপ না সিদ্ধ চাল ছিলো তারা খেয়াল করেননি বলে জানান। আরো দুজন বলেছেন সিদ্ধ ও আতপ দুটি বিলি করতে দেখেছেন। একজন বলেছেন সাংবাদিকের ফোন পাওয়ার পর ডিলার আতপ পরিবর্তন করে সিদ্ধ চাল বিলি করেছেন।
ভোক্তা পর্যায়ে তদন্ত
তদন্ত কমিটি ভোক্তা পর্যায়েও তদন্ত চালিয়েছে। গৌরারাং ইউনিয়নের ডিলার নূর আহমদ, মনিরুল হক, মো: এরশাদ, রনজিত দাশ, সুজন নন্দীর ডিলার পয়েন্ট থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল সংগ্রহকারী ভোক্তাদের ১৫ জনের মধ্যে একজন ছাড়া সকলে আতপ চাল পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটিকে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে রঙ্গারচর ইউনিয়নের ডিলার নূরুজ্জামান, সামসুল হক ও মো: মহসিন এর ডিলার পয়েন্ট থেকে চাল সংগ্রহকারী কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলে সকলেই আতপ চাল পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ডিলার মিজানুর রহমান, অরুণ দাস, নিলয় কান্তির ডিলার পয়েন্ট থেকে আতপ চাল বিলি করা হয়েছে। কুরবাননগর ইউনিয়নের আতিকুর রহমান, জসিম উদ্দিন সরকার, আসকর আলীর ডিলার পয়েন্ট থেকে ভোক্তাদের আতপ চাল দেয়া হয়েছে। সুরমা ইউনিয়নের ডিলার এরন মিয়া, জহিরুল ইসলাম, সবুজ মিয়া, ইকবাল হোসেন, জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের ডিলার আব্বাস আলী, আব্দুল খালেক, অহিদুল ইসলাম, কঠাইর ইউনিয়নের ডিলার জালাল উদ্দিন, আব্দুল আউয়াল এবং লক্ষণশ্রী ডিলার পয়েন্ট থেকে আতপ চাল বিলির সত্যতা পাওয়া যায় । এছাড়া মোহনপুর ইউনিয়নের ডিলার আবু তালেব ও মনি মোহন দাস এর ডিলার পয়েন্ট থেকে ৫ জন ভোক্তা সিদ্ধ চাল পেয়েছেন বলে জানান। সর্বমোট ৬৩ জনের বক্তব্য নেয় তদন্ত কমিটি। এরমধ্যে ৫৫ জনই আতপ চাল পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
তদন্ত কমিটির মতামত
তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছে। মতামতের মধ্যে রয়েছে “রেকর্ডপত্র অনুযায়ী মল্লিকপুর এলএসডি হতে ওয়ারেন্টি মোতাবেক ১জন ডিলারকে আতপ চাল, ১জন ডিলারকে আতপ ও সিদ্ধ চাল এবং অবশিষ্ট ২৫ জন ডিলারকে সিদ্ধ চাল বিলি করা হয়েছে। তবে সরেজমিনে তদন্তে সকল ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ভোক্তাদের নিকট ফেব্রুয়ারি/২০২০ মাসে আতপ চাল বিক্রির সত্যতা পাওয়া গেছে”। ‘ডিলারগণ ইস্যুকৃত ডিও, এলইউএতে স্বাক্ষর করে মল্লিকপুর এলএসডি হতে সিদ্ধ চাল বুঝে নিয়েছেন। তাছাড়া কমিটির নিকট লিখিতভাবে সিদ্ধ চাল গুদাম হতে গ্রহণ করেছেন মর্মে জানিয়েছেন। তাই সিদ্ধ চাল গ্রহণ করে আতপ চাল বিক্রি করার দায় সংশ্লিষ্ট ডিলারদের উপর বর্তায় মর্মে কমিটি মনে করে”।
“যৌথস্বাক্ষরে প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা প্রদানের নিয়ম থাকলেও এ ক্ষেত্রে কোন ডিলারের নিকট নমুনা ব্যাগ পাওয়া যায়নি এবং এলএসডি হতে কোন নমুনা প্রদান করা হয়নি মর্মে ডিলারগণ তাদের লিখিত বক্তব্যে কমিটিকে জানিয়েছেন।
এব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান মৌলভীবাজারের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জ্যোতি বিকাশ চাকমা দৈনিক সিলেটের ডাককে বলেন, গত ১৫ মার্চ সিলেটের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনেই বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্তে কোন প্রকার গাফিলতি করা হয়নি।
সিলেটের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাইন উদ্দিন জানান, তিনি তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে সাথে সাথে সুনামগঞ্জের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন। তাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাইনুল ইসলাম দাবি করেন, তিনি ঢাকায় ছিলেন যার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন এখনো খুলে দেখেননি। তবে প্রতিবেদনের আলোকে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে উপজেলা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সদস্য সচিব সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বেনু গোপাল দাস জানান, তদন্ত কমিটি জড়িত ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নিবেন। সে ক্ষেত্রে ডিলারশিপ বাতিলও হতে পারে।