আর্থসামাজিক উন্নয়নে রেমিটেন্সের ভূমিকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ মার্চ ২০২৩, ৪:২৩:০০ অপরাহ্ন

ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি লাভ করছে। দেশের জি.ডিপি বৃদ্ধির ফলে মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জীবযাত্রার মান পূর্বের তুলনায় উন্নত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করছে গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ এবং রেমিটেন্সের বৃদ্ধি। ২০২১ সালের বাংলাদেশের রেডিমেইড গার্মেন্টস রপ্তানীর পরিমান ছিলো প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫ শত কোটি টাকা যা সেই সময়ের জিডিপি এর ৭.৫৬ শতাংশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রাপ্ত মোট রেমিটেন্সের পরিমান ছিলো প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা যা জিডিপি এর ৫.২৮%। ২০২২ সালে দেশে প্রাপ্ত রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিলো ২ লাখ ২২ হাজার ৬ শত কোটি টাকা যা জিডিপি এর ৪.৫৫%। ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিশে^র সপ্তম রেমিটেন্স অর্জনকারী দেশ ছিলো। বাংলাদেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আমেরিকা, কুয়েত, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ থেকে সর্বাধিক রেমিটেন্স পেয়ে থাকে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আমেরিকার কাছ থেকে রেমিটেন্স পেয়েছে যথাক্রমে ৪২ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, ২৬ হাজার ২ শত কোটি টাকা এবং ২৫ হাজার ৪ শত ৭৬ কোটি টাকা। একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত মোট রেমিটেন্সের ১৭.৩৯% ব্যয় হয় জমি ক্রয়ে, ৩৩.৪৫% ব্যবহৃত হয় বিনিয়োগে এবং সঞ্চয়ে হয় ১৩.৭৪%।
বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রবাসির সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ি, সৌদি আরবে বসবাস করেন প্রায় ২৫ হাজার প্রবাসি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১২ লাখ এবং যুক্তরাজ্যে এর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। ২০২২ সালের অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে দেশে সর্বোচ্চ ১০,২৫০ কোটি টাকা রেমিটেন্স এসেছে আমেরিকা থেকে এবং সৌদি আরব থেকে এসেছে প্রায় ৯,৬৫০ কোটি টাকা। আমেরিকায় অবস্থারত বাংলাদেশী প্রবাসিগনের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক থাকার ফলে আমেরিকা থেকে প্রচুর পরিমান রেমিটেন্স এসেছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিক যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রায় ৫ কোটি জনগন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রেমিটেন্সের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। ২০১৯ সালে দেশ থেকে প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক বিশে^র বিভিন্ন দেশে গেছেন। ২০২১ সালে এর সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার। বিভিন্ন দেশে গমনকারী শ্রমিকের মাঝে প্রায় ৭৫% শ্রমিক অদক্ষ শ্রেণির। এ দুই বছরের বিদেশ গমনকারী শ্রমিকগণের ৯০% এর চেয়ে বেশি গমন করেছেন সৌদি আর এবং ওমানে। বিদেশে গমনকারী অদক্ষ শ্রমিকের মাঝে বেশির ভাগই কুমিল্লা এবং বি-বাড়িয়া জেলার অধিবাসী।
বিভিন্ন তথ্য এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সৌদিআরব, ওমান, সংযুক্ত আরব-আমিরাত সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং মালোয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশের প্রবাসিগনের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক শ্রেণির। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ প্রধানত খরচ হচ্ছে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে। তাদের প্রেরিত অর্থে আমাদের গ্রামীন অর্থনীতি বিকাশ লাভ করছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কিছুদিন পূর্বে সুযোগ হয়েছিল সিলেট জেলার কানাইঘাটের গাছবাড়ী বাজারে যাওয়ার। আশ্চর্য হলাম এবং দেখলাম, যে বাজারে ১৫/২০ বছর পূর্বে উল্ল্যেখ করার মত খুব একটা কিছু ছিল না কিন্তু বর্তমানে সে বাজারে এসি, ফ্রিজ, মোবাইল সেট ইত্যাদি সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। বড় ধরনের মিষ্টির দোকান, কনফেকশনারী ইত্যাদিতে বিদেশী প্রসাধনী সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের বিলাসী পন্য বিক্রি হচ্ছে। প্রবাসিগনের মাধ্যমে প্রেরিত অর্থে গ্রামীন অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। বিলাসী পন্য ব্যবহারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাড়ছে জীবনযাত্রার মান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী প্রবাসী রয়েছেন। দেশে বৃহৎ বিনিয়োগ করতে আর্থিক ভাবে সক্ষম এমন প্রবাসিগন এ দেশ সমূহে বাসবাস করেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে বসবাসরত বাংলাদেশীগন যারা দীর্ঘদিন ধরে সেসব দেশে অবস্থান করছেন তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশে থাকা তাদের সম্পত্তিসমূহ ইতিমধ্যেই বিক্রি করে ফেলেছেন অথবা বিক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এর ফলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্রামান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং এতে দেশে প্রাপ্ত রেমিটেন্স হ্রাস পেতে পারে। কথা হলো, স্কুল জীবনের সহপাঠী এবং ইংল্যান্ডের স্টাফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. শহীদুল হাসান বাপ্পীর সাথে যিনি ইতিপূর্বে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি জানালেন চাকুরিজীবি এবং অন্যান্য কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশী প্রাবাসিগনের দেশে সম্পত্তি ক্রয়ের চেয়ে ইংল্যান্ডে সম্পত্তি ক্রয়ে আগ্রহ বেশি। বাংলাদেশে বিশ^স্ত ব্যক্তির অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা ইত্যাদির কারনে দেশে অর্থবিনিয়োগে চাকুরিজীবিগন আগ্রহ হারাচ্ছেন। প্রক্ষান্তরে, ব্যবসায়িক মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিগণ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, সিলেট শহরের রোজ ভিউ হোটেল, গ্রান্ড সিলেট হোটেল, হবিগঞ্জের বাহুবলে অবস্থিত দি প্যালেস রিসোর্ট, সিলেটের বারাকা পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানী, বিভিন্ন রিসোর্ট, শপিং মল, বিভিন্ন হাসপাতাল ইত্যাদিতে ইংল্যান্ডে অবস্থানরত প্রবাসিগনের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে অবস্থানরত ধর্নাট্য শ্রেনির ব্যক্তিগণকে দেশে বিনোয়োগে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধিকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিকারী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিৎ।
দেশে অবস্থানরত সম্ভাব্য সক্ষম উদ্যেক্তাগণ বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহন করে প্রবাসিগনকে বিনোয়োগে আগ্রহী করা একান্ত প্রয়োজন। এতে দেশের সাথে প্রবাসিগনের এবং প্রবাসিগনের পরবর্তী প্রজন্মের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। প্রবাসিগনের মাধ্যমে প্রেরিত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চন্তে করা প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় সংকোচন করা দরকার। প্রবাসিগনের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি সংক্রান্ত সমস্যা, বিশ^স্থ ব্যক্তির অভাব এবং ব্যবসায়িক ঝুঁকি গ্রহনের অনিহা একটি বড় সমস্যা। প্রবাসিগনের বিনোয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগের খাতসমূহ সনাক্ত করা প্রয়োজন। বর্তমান প্রজন্মের অনেক প্রবাসি দেশে আসতে চাইলে অনেকক্ষেত্রে অত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতগনের কাছ থেকে তেমন আগ্রহ দেখতে সক্ষম হন না। বিভিন্ন জনকল্যানমূলক এবং ধর্মীয় কর্মকান্ডে প্রবাসীগণের বিরাট অবদান রয়েছে।
প্রবাসিগন আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। প্রবাসিগনের সমস্যাগুলো চিহ্ন করে সেগুলো দূরীকরণের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা এবং এর সঠিক বাস্তবকরণ প্রয়োজন। প্রবাসিগনকে ধন্যবাদ। আপনাদের প্রেরিত কষ্টার্জিত অর্থে সমাজ, শহর কেন্দ্রিয় অর্থনীতি, গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। শুধু অর্থপ্রেরণই নয় বরং আপনাদের সুচিন্তিত মতামত এবং দিকনির্দেশনা আমাদের আত্মিক-অর্থনীতিক-সামাজিক উন্নয়নে একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, সিলেট।