স্বাভাবিক বাজারের প্রত্যাশা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ মার্চ ২০২৩, ২:৩৭:৪৪ অপরাহ্ন
মোনায়েম সরকার
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আমার মনোযোগ কেড়েছে।
তিনি বলেছেন, ‘পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে ভোক্তাসাধারণ এক মাসের পণ্য একসঙ্গে না কিনে কম পরিমাণে একাধিকবার কিনলে আলাদা করে পণ্যের চাহিদা বাড়বে না। ব্যবসায়ীরাও সুযোগ নিতে পারবেন না।’
একথাও তিনি বলেছেন, ‘ধর্ম বলেছে সংযমী হতে, নিজেকে কন্ট্রোল করতে। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে একটাই কথা বলতে চাই, অন্তত এ মাসটায় একটুখানি সংযমী হওয়া দরকার। আপনারা দয়া করে যেটি ন্যায্য হওয়া উচিত, সেটাই করবেন। আমরা আপনাদের সারাদিন ধরে পাহারা দিয়ে রাখতে পারব না। তারপরও আমরা চেষ্টা করব। আপনাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন দিয়ে গেলাম, আপনারা যেটি ন্যায্য হয়, সেটা করবেন।’
বাণিজ্যমন্ত্রী ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষের উদ্দেশেই ন্যায়সংগত আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে তার কথা সবাই শুনবেন, এতটা আশা করা যায় না। মাসের বাজার একসঙ্গে করার অভ্যাস অনেকেই ত্যাগ করবেন না। আবার ব্যবসায়ীদের বড় অংশটাই অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। তবে এবার বিভিন্ন পর্যায় থেকেই রমজানে বিশ্বের কিছু মুসলিম দেশের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম কমিয়ে রাখার আহ্বান জানানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতিও কিছুদিন আগে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের ডেকে আলোচনার সময় একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাতে কাজ না হলেও বলব, বার্তাটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে গিয়েছে।
ইতিবাচক কথাবার্তা শুরু হওয়া নিশ্চয়ই ভালো। এক সময় তো আমরা রমজান উপলক্ষে ছাড় দিয়ে পণ্যসামগ্রী বিক্রির কথা জানতামও না। এখান থেকে যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যায়, তাদের অনেকে রমজানে ডিসকাউন্টে পণ্য কেনার সুযোগ পেয়ে থাকে। তাদের মাধ্যমেই এ খবর প্রথম দেশে এসে পৌঁছে। আর এখন তো সব খবরই অনলাইনে পাওয়া যায়। দেশের পত্রপত্রিকায়ও এসব খবর ছাপা হয়। টিভিতেও রমজানে ছাড় দিয়ে পণ্যসামগ্রী বিক্রির খবর আসছে। অথচ রমজান আসার আগেই আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা এটাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে থাকে। দরিদ্র ক্রেতাদের প্রতিও তাদের কোনো মমতা কাজ করে বলে মনে হয় না। মন্ত্রী যেমনটি বলেছেন-অন্তত রমজান মাসে তারা কি পারেন না স্বাভাবিক মুনাফা করতে? সারা বছরই তো ব্যবসা করেন। তাহলে এ সময়ে তারা কেন বিশেষ মনোভাব গ্রহণ করেন? এর একটি প্রেক্ষাপট অবশ্য তৈরি করে দেয় ভোক্তারাই। তাদের অনেকে একবারে মাসের বাজার করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে। ব্যবসায়ীরাও এর সুযোগ নেয়।
আমার বয়স হয়েছে। এক সময় মাঝেমাঝে নিজে গিয়ে রাজধানীর একটি বাজার থেকে কিছু কেনাকাটা করতাম। তখনো দেখেছি, বাজারে পণ্যের ঘাটতি নেই। যেসব পণ্য সর্বস্তরের মানুষ সচরাচর কিনে থাকে, সেগুলোর ঘাটতি এখনো নেই। এখন যে ছেলেটি আমাদের কাঁচাবাজার করে দেয়, তার কাছ থেকে এ তথ্য সবসময়ই পাই। পত্রপত্রিকা পড়ে আর টিভি দেখেও জানতে পারি। তাহলে একসঙ্গে গাদা গাদা পণ্যসামগ্রী যারা কিনছেন এখনো, তারা কারা? তারা কি মনে করেন, বাজার থেকে জিনিসপত্র হাওয়া হয়ে যাবে? এমনটা কি কখনো হয়েছে? আমরা জানি, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। কী কারণে এটা হয়েছে, তাও আমাদের অজানা নয়। কিছু পণ্যের আমদানিতে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সরকার সে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছে। এ খবর মিডিয়ায় প্রকাশিতও হচ্ছে। তাহলে কেন এ অতিরিক্ত কেনাকাটা? যারা এটি করছেন, তারা হয়তো অবস্থাপন্ন লোকজন। কিন্তু তাদের কাজে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা যেমন এর সুযোগ নিচ্ছে, তেমনি সাধারণ ক্রেতারাও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ছে। এ অবস্থায় বাজারে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। সে কথাটিও বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসে জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে।
আমাদের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনও রয়েছে। তবে অধিদপ্তর ও আইন থাকার কথা অধিকাংশ মানুষ অর্থাৎ ভোক্তাসাধারণ জানে না। তারা কোনো কারণে প্রতারণার শিকার হলে যে আইনের আশ্রয় নিতে পারে বা অধিদপ্তরে অভিযোগ করে প্রতিকার পেতে পারে, সেটা জানে না। এটা অবশ্য তাদের দোষ নয়। তাদের কাছে নিজেদের অধিকারসংক্রান্ত এসব তথ্য পৌঁছানোর দায়িত্ব সরকারের। ভোক্তা অধিদপ্তরের লোকবল কম, একথা প্রায়ই শোনা যায়। রমজান মাসে যখন বাজারে মনিটরিং জোরালো করা প্রয়োজন, তখন এটা বেশি শোনা যায়। সরকারকে এদিকে দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে। আমরা অনেক সময়ই দেখতে পাই, প্রশাসনের কোথাও অতিরিক্ত জনবল রয়েছে; আবার কোথাও জনবলের অভাব। কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জনবলের অভাব থাকলে তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জনবলের অভাব কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জনবল বাড়িয়ে এটিকে শক্তিশালী করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তারা যেন কেবল রমজান মাসে নয়, সারা বছরই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর বাজারে মনিটরিং চালিয়ে যেতে পারে। তাহলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে না চাইলেও তাতে সফল হবে না। ডরেভয়ে হলেও ক্রেতা ঠকানোর পন্থা থেকে সরে আসবে। ভোক্তারাও আস্থা পাবে যে, সরকার তার সঙ্গে রয়েছে।
সরকার আসলে থাকবে ন্যায়পরায়ণ সবার সঙ্গে। ভোক্তাদের পক্ষে অসৎ কাজের সুযোগ নেই বলেই আসলে তাদের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। সর্বস্তরের ব্যবসায়ী যাতে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করতে পারে, সেটাও কি সরকার দেখছে না? সরকার তো ব্যবসাবান্ধব। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কেউ বলছে না যে, সরকার ব্যবসাবিরোধী। এক সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি অংশ সরকার পরিচালনা করত। অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখা গেল, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারে না। সেক্ষেত্রে বরং অনেক বাড়তি সমস্যা জন্ম নেয়। অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়ে। প্রতিষ্ঠানও অদক্ষ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরে এসেছে। বেসরকারি খাতকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। আর এ নীতি সব সরকারের আমলেই অনুসরণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ এ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক মতপার্থক্যও নেই। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের কাজ হলো ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবসা করা। এর একটি বড় পূর্বশর্ত ভোক্তাকে জিম্মি না করা এবং স্বাভাবিক মুনাফায় সন্তুষ্ট থাকা। বাণিজ্যমন্ত্রী সেটিই বলতে চেয়েছেন বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসে।
ব্যবসায়ীদের সরকার ‘সারাদিন ধরে পাহারা দিয়ে’ রাখতে পারবে না বলে যে মন্তব্য তিনি করেছে, তাতে একটা দুঃখবোধও আছে। ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ আশা করি তা উপলব্ধি করতে পারবেন। তাদেরও কি দায়িত্ব নেই ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা, সেটা দেখার? একদল ব্যবসায়ী যদি সুযোগ বুঝে ক্রেতা ঠকানোর কাজটি অব্যাহত রাখে, তাতে কি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে? ব্যবসায়ীদের একটি দলকে দেখা যায় আরেক দলকে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ার জন্য দায়ী করতে। কোনো পক্ষই দায় কাঁধে নিতে চায় না। সরকার পণ্যের দাম কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিলেও দেখা যায় বাজারে এর সুফল মিলছে না। তখন বলা হয়, সরকার ওই পদক্ষেপ না নিলে দাম আরও বাড়ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক সময় অবশ্য যৌক্তিক কারণেও বাড়ে। মানুষের কাছে সেটি ব্যাখ্যা করা যায়। লোকে তা মেনেও নেয়। কিন্তু অযৌক্তিক কারণে দাম বাড়লে মানুষ মেনে নিতে পারে না। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি তারা এজন্য সরকারকেও দায়ী করে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সহায়তা না পেলে সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
এক্ষেত্রে ভোক্তা সচেতনতাও জরুরি। বাণিজ্যমন্ত্রী তার বক্তৃতায় ভোক্তা সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে ভালো করেছেন। সচেতন ভোক্তা ছাড়া স্বাভাবিক বাজার পাওয়া সম্ভব নয়। পশ্চিমা দেশের কথা পাশে রেখেও যদি প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব-তাদের অধিকাংশ ভোক্তাই আমাদের চেয়ে সচেতন। বাজারে তারা অধিকারসচেতন। পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে তারা অনেক বেশি বিক্ষুব্ধও হয়ে ওঠে। আর আমাদের দেশে ভোক্তাদের পণ্যের দাম ও মানের বিষয়ে প্রশ্ন করতেও দেখা যায় না। খুব কম প্রতারিত ক্রেতাই এ পর্যন্ত অভিযোগ জানিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তরে। অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার পায়নি, এমনটি কিন্তু দেখা যায়নি। আন্দাজে অভিযোগ জানিয়ে ব্যবসার ক্ষতিসাধন নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়। একশ্রেণির ভোক্তার মধ্যে এ প্রবণতা রয়েছে। রমজানে আমরা আশা করব, শুধু শহর নয়-মফস্বলেও মনিটরিং জোরদার করা হবে। ব্যবসায়ীরাও তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এগিয়ে আসবে। বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসে এবার একটি বিশেষ সফটওয়্যার উদ্বোধন করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী, যাতে এর মাধ্যমে সহজে অভিযোগ দায়ের করতে পারে প্রতারিত ভোক্তা। আমরা আশা করব, এসব উপায়ে বাজারে ভোক্তার অধিকার জোরদার হবে।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর