সত্যকে শ্রদ্ধা করবো
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মার্চ ২০২৩, ১:৩৪:৫৮ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের প্রত্যেকটি জাতির জাতীয় জীবনে এমন কতোগুলো সত্য আছে যা কখনো অস্বীকার করা যায় না। এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। আর ঐতিহাসিক সত্য বড়োই কঠিন। একে অস্বীকার করতে গেলে নিজেদের অবস্থানই নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সত্য কথাটি বলেছেন। যেমন- ‘সত্যকে অস্বীকার করিয়া ভ-ামি দিয়া কখনো মঙ্গল উৎসবের কল্যাণ প্রদীপ জা¡লিবে না।’ আমাদের দেশতো আছেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সত্যকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা ভীষণভাবেই পরিলক্ষিত হয়ে আসছে এবং সেটা বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই। এতে কী যে লাভ তা বুঝে ওটা খুবই মুসকিল। আমরা ধরে নিলাম আমরা সবাই এই বাংলাদেশে মঙ্গল উৎসবের কল্যাণ প্রদীপ জ্বালাতে চাই কিন্তু ভ-ামি দ্বারা কি তা সম্ভব? ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয় না। বিশ্ব ইতিহাসে তেমনি এক ঐতিহাসিক সত্য হলো ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালোজয়ী ভাষণ। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশের জন্মের সূতিকাগার এই ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই শব্দাবলীই বলতে গেলে বাংলাদেশের অন্য নাম। এই শব্দাবলীই আমাদের মুক্তি সংগ্রাম। আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু একাত্তরের সেই ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে এদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে এই ভাষণের কতোটুকু মূল্যায়ন করা হয়ে আসছে তা ভেবে দেখার বিষয়।
আর যদি মূল্যায়ন করা হয়ে থাকতো তাহলে একাত্তর থেকে এই ২০২৩ এ এসে দেখতে হতো না দেশের পত্র পত্রিকায় খবরের শিরোনাম ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সব স্কুল-কলেজে উদযাপনের নির্দেশ।’ নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর-এর ভাষণের দিনটিকে সব স্কুল-কলেজে “ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ” দিবস হিসেবে উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। দিবসটিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাতে হবে।’ এই নির্দেশটি শুনার পর আজ ২০২৩ এ এসে কেন জানি মধু কবির মহাকাব্যের সেই বিখ্যাত একটি বাক্য- ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’ এর কথা ভীষণভাবেই মনে পড়লো। এই ‘কেন জানি’ এর ‘কেন’টির উত্তর হলো- এ নির্দেশটি ১৯৭২ এর ৭ই মার্চই তো আসার কথা ছিলো। হয়নি। তবে দেরীতে হলেও হয়েছে। এর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্তৃপক্ষকে অশেষ ধন্যবাদ জানাতেই হয়। তবে এই শুভকর্মটি ১৯৭২ সাল থেকে চালু হলে নতুন প্রজন্ম এই ঐতিহাসিক সত্যটিকে জানা থেকে বঞ্চিত হতো না। ১৯৭২ সালের নতুন প্রজন্ম কিন্তু আজ ৫০ বছরের পুরানো। এই প্রজন্মটি অনেক জাতীয় ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আজকের অবস্থানে এসেছে। তারা দেখেছে অনেক ইতিহাস বিকৃতি। তাই বলছিলাম ১৯৭২ সাল থেকে এই নির্দেশটি চালু হলে ইতিহাস বিকৃতির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা অনেকটাই রোধ করা যেতো! তবে সবচেয়ে চরম সত্যটি হলো, আলো-আঁধারের খেলায় আলোকে আঁধার চিরদিন ঢেকে রাখতে পারে না। সত্যের প্রকাশ একদিন হতে বাধ্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ ও জাতির ইতিহাসে কিছু কিছু জাতীয় দিবস আছে যা সমগ্র জাতির; কোন দলীয় বা গোষ্ঠীর একক সম্পত্তি নয়। বাঙালি জাতির জীবনেও তেমনি একটি দিবস হলো ৭ই মার্চ। এটা সর্বজনীন। দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের কথাই যদি বলি তাহলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব-আদর্শ-উদ্দেশ্য-চিন্তা-চেতনা বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারণা আলাদা আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। আর কালের ¯্রােতে নতুন নতুন রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দল বা গোষ্ঠীর জন্ম হবে এটাও স্বাভাবিক ঘটনা। এতে কারো কোনো আপত্তি বা দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গেলে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে বিতর্ক থাকা কোনো অবস্থাতেই সমীচিন তো নয়ই বরং এটা নিরেট ইতিহাসকে অস্বীকার করারই নামান্তর বৈ কিছু নয়। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আর একটি ৭ই মার্চের ভাষণ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। ৭ই মার্চের ভাষণ এক এবং অদ্বিতীয়। গোয়েবলস কেন, ওর বাপ দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীরও সাধ্য নেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি মিথ্যা প্রমাণ করার। যদিও সে কোনো কোনো মিথ্যাকে বার বার বলে বলে সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থতাই তার কপালে ঝুটেছে। বাংলাদেশকে স্বীকার করলে, বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস বা মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করলে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এখানে কোনো ধরনের হীনমন্যতার স্থান নেই।
কথায় বলে ‘কান টানলে মাথা আসে।’ এটা বড়োই সত্য কথা। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ সব স্কুল-কলেজে উদযাপনের নির্দেশের ফলে বাংলাদেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারবে ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের জন্মের ক্ষেত্রে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো। নিন্দুকেরা যে যা-ই বলুক, মূলত ৭ই মার্চের পর থেকেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। সেদিন সারা বিশ্ব জেনে ছিলো যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও জিন্নাহ সাহেবের সেই পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিলো না। সবই চলতো বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশে। কোর্ট-কাছারি-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই। সেটা কি সারা বিশ্বের সাংবাদিক ভাইদের চোখে পড়েনি? অবশ্যই পড়েছে। আর সে জন্যই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। এই স্বীকৃতি কি এমনি এমনি দেয়া হয়েছে? কোনো লবিস্ট এর কারণে হয়েছে? কে লবিস্ট নিয়োগ করবে? ৭ই মার্চের ভাষণের পর তো বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগের একক সম্পদ রইলেন না। তিনি এবং তাঁর ভাষণ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সম্পদ হয়ে গেলেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বলে দিতে চাই আজ থেকে কোর্ট-কাছারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।’ ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ এই আহ্বানে যে শুধু ঢাকা শহর সহ সারা দেশের শহর বন্দরেই মানুষ জেগে উঠেছিলো তা নয়। এ ভাষণের পর বাংলার হাটে ঘাটে-মাঠে তথা গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষও মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্য পাগল প্রায় হয়ে উঠেছিল।
তাহলে আজ কিসের লজ্জা? কিসের ভয়? কেন আজ আমরা সবাই বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে সম্মিলিতভাবে অন্তরে ধারণ করতে পারছি না? এই ৭ই মার্চ উদযাপন বা স্মরণ করার অধিকার তো কারো একার নয়! নয় কোন দল বা গোষ্ঠীর। ইতিহাস বলে এ অধিকার সকলের! যেমনি ছিলো ১৯৭১ এর ৭ই মার্চে। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উদযাপনের জন্য এই ৫০ বছর পর আমরা কেন বসে থাকবো কারো নির্দেশের অপেক্ষায়। বিশ্ব কবি বলেছেন, ‘সত্যের লজ্জা নাই, ভয় নাই, ভাবনা নাই। সে নিজেকে প্রকাশ করা ছাড়া তার আর গতি নাই, এইজন্য সে বেপরোয়া।’ তাহলে সত্যকে স্বীকার করতে, প্রকাশ করতে, স্মরণ করতে, পালন করতে, উদযাপন করতে আমরা কেন বেপরোয়া হব না? তাই আসুন- কারো আদেশ-নির্দেশে নয়, একান্ত অন্তরের তাগিদেই বছর বছর ৭ই মার্চ উদযাপনে আমরা বেপরোয়া হই। বলি জয় বাংলা, জয় ৭ই মার্চ। এটাইতো বাংলার ইতিহাস।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।