ফেরদৌস আরা চৌধুরী এক সন্ত মুক্তিযোদ্ধা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মার্চ ২০২৩, ১:৪২:১৮ অপরাহ্ন
আবিদ ফায়সাল
একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই-ই সর্বাত্মক এই যুদ্ধে শামিল ছিলেন সমানভাবে। নারীসমাজ লড়াই করেছেন, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, রক্ষা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে, শরণার্থীদের শিবিরে খাবার দিয়েছেন। বিদেশের মাটিতেও নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। রণাঙ্গনে দাঁড়িয়েও বিপুল বিক্রমে লড়েছেন নারীরা। নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তবু আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন আজও ব্যাপকভাবে হয়নি। ১৯৭১ সালে এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় দুই দশকজুড়ে এদেশে নারী মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। এখনও কারও কারও নাম বিস্মৃতির অন্ধকারে। এমনই একজন ফেরদৌস আরা চৌধুরী। তিনি সন্ত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর স্বামী দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের কিংবদন্তিতুল্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ চৌধুরী। মানিক মিয়া বা মানিক চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত। পাঁচ নম্বর টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। একই গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য ফেরদৌস আরা চৌধুরী। তাঁরা সংসারসমরে মিলিত হয়েছিলেন একাত্তরে। তাঁদের বিবাহকে কেন্দ্র করে কোনও উৎসব আয়োজনের সুযোগ ছিল না সেদিন, তবে ভাসান পানিতে নৌকার গোড়ায় বসে আতসবাজির পরিবর্তে সহযোদ্ধারা গোলাবারুদ ফুটিয়ে ছিলেন আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে। ভরা বর্ষার মৌসুমে।
বিয়ের পরপরই ফেরদৌস আরা চৌধুরী ভাসুরের শ্বশুরালয় দুগনুইগ্রামে চলে যান। স্বামীকে নিয়ে ভাসুর প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরীর শ্বশুর আক্কল আলী তালুকদার ও তাঁর পরিবারকে রাজাকারদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করে বাহাতলা শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। আবদুল মজিদ চৌধুরী তাঁর ‘আমরণ মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে লিখেছেন,’ স্ত্রী ফেরদৌস আরা চৌধুরীও আমার যুদ্ধজীবনের অংশী। পরের সংগ্রামেও ছিলেন সমান বিক্রমে সহযোদ্ধা। … মুক্তিযুদ্ধকালে অসামান্য সহযোগিতা করেছেন। তিনিও অস্ত্র চালনা শিখেছিলেন আমার কাছ থেকে। সর্বক্ষণ সতর্ক পাহারায় থাকতেন। অস্ত্র সংরক্ষণ করতেন। যুদ্ধ-প্রস্তুতির পাশাপাশি মানুষের সেবা-শুশ্রূষায় এবং আপ্যায়নে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। আমাকে খুঁজে যাঁরা আসতেন, বিশেষ করে সহযোদ্ধা, আহত মুক্তিযোদ্ধা- তাঁদেরকে খাবারদাবার এবং শুশ্রূষা দিতেন সাধ্যমতো।’ (পৃ.৩১)
যুদ্ধকালে ফেরদৌস আরা চৌধুরী ভারতের বরছড়ায় থাকতেন। তাঁকে সহযোগিতা করতেন দেবর স্বাধীন চৌধুরী এবং রশিদ আলী। তাঁদের নিয়ে তিনি শরণার্থী শিবিরে যেতেন। জরুরি প্রয়োজনে প্রসূতি মায়েদেরও সাহায্য করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো স্মরণ করে ফেরদৌস আরা চৌধুরী বলেন, সে-সময়ে আমাদের মৃত্যুর শঙ্কা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী জীবনযাপন ছিল দুর্বিষহ। স্বাধীনতাবিরোধীরা হামলা-মামলা এবং নির্যাতন করেছে আমার স্বামীকে। ভাটিপাড়া জমিদারপরিবারের কতিপয় সদস্য তাঁর নামে বহু মামলা করে। তাদের চেলা বাক্কল আলী প্রায়ই হেন্ডকাপ নিয়ে হাজির হতো। পুলিশ সঙ্গে নিয়ে হানা দিতো। তিনি তখন বাইরে থাকতেন। রাতের বেলায় মান ইজ্জতের ভয়ে ঘরের পেছন দরজা খুলে আমি পালিয়ে যেতাম। আত্মীয়স্বজনদের ঘরেও আশ্রয় পেতাম না। একদিন ঝোপঝাড়ে লুকাতে গিয়ে কাঁটার আঘাতে মারাত্মকভাবে রক্ত ঝরেছিল। পরে বাধ্য হয়েই তাঁকে কারাবরণ করতে হয় এবং দেশত্যাগও করতে হয়। এক সন্তান স্বদেশে রেখে আমাকেও উদবাস্তু জীবন বরণ করতে হয়।’
ফেরদৌস আরা চৌধুরী প্রশ্ন ছোড়েন, ‘কী অপরাধ ছিল আমাদের? স্বাধীনতা অর্জনের একান্ন বছর পর এসেও কি স্বদেশে সসম্মানে মরতে পারবো না?’
ফেরদৌস আরার মতন এমন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাঁদের শুধুই জীবনের নিরাপত্তা কিংবা আর্থিক এবং সামাজিক মর্যাদা নয়, ইতিহাসেও স্থান দিতে হবে।
লেখক : কবি।