হাখম-খেয়ার যোগাযোগে জগন্নাথপুরের ১২ গ্রাম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মার্চ ২০২৩, ৬:৪৩:৪৬ অপরাহ্ন
বাঁশের সাঁকো নির্মাণে প্রতিবছর ব্যয় হয় ৫ লাখ টাকা
কাউসার চৌধুরী
বর্ষাকালে খেয়া নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের সাঁকো। যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম উৎকর্ষের যুগেও মান্ধাতার আমলের খেয়া ও সাঁকোয় ভরসা করে চলছেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের ১২ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। আশারকান্দি ইউনিয়নের হালোখাল নদীর ওপর সেতুর আদলে বাঁশের সাঁকো ও খেয়া দিয়েই লোকজনকে যাতায়াত করতে হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হলেও বর্ষায় একমাত্র অবলম্বন খেয়া নৌকা।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, প্রায় ২০ বছর ধরে প্রতি অগ্রহায়ণ মাসে সেতুর আদলে সাঁকো নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা। বছরের পর বছর ধরে এভাবে অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করা হলেও স্থায়ী সেতু নির্মাণের বাস্তব কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না ।
খোদ এলজিইডি’র জগন্নাথপুর উপজেলা প্রকৌশলী সোহরাব হোসেনও সিলেটের ডাককে ওই বাঁশের সেতুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, হালোখাল নদীতে বর্তমানে বাঁশের সেতু আছে। এখানে একটি সেতু নির্মাণের জন্যে এলজিইডির বিশেষজ্ঞ দল এসেছিল। তারা সার্ভে করে গেছেন। সার্ভে অনুযায়ী ডিজাইন তৈরি করা হবে। ডিজাইনটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত ডিজাইন হয়ে গেলেই সেতু নির্মাণের প্রকল্প তৈরি করা হবে। প্রকল্প তৈরি হয়ে গেলে বাস্তবায়নে তেমন দীর্ঘ সময় লাগবে না। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসী অধ্যুষিত জগন্নাথপুর উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের হালোখাল নদীর ওপর সেতু না থাকায় এলাকাবাসীকে যুগের পর যুগ ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বর্ষায় নৌকা আর শুকনো মৌসুমে সাঁকো দিয়ে কোনোমতে চলাচল করতেন। এই ভোগান্তি থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পেতে একসময় এলাকাবাসী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্যে তারা বিকল্প উপায়ে যাতায়াতের মাধ্যম গড়ে তুলেন। নদীর উত্তরপাড়ের উত্তর দাওরাই ও দক্ষিণ পাড়ের দাওরাই পশ্চিমপাড়ার মধ্যে বাঁশের অস্থায়ী সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন তারা। অবশ্য, এটি প্রায় দুই দশক আগের কথা।
স্থানীয় পঞ্চায়েতের উদ্যোগে এখানে বাঁশের ওই সেতুটি গেল ২০ বছর ধরে নির্মাণ করা হয়। এজন্য কয়েক জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে।
দায়িত্বপ্রাপ্তরা এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় বাঁশ কিনে এনে শুকনো মৌসুমের শুরুতে অগ্রহায়ণ মাসে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রায় ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য এই সেতু নির্মাণে কাজ করেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত লেগে যায়।
সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের অন্যতম আব্দুল বাছির সিলেটের ডাককে বাঁশের ওই সেতু নির্মাণের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘দাওরাইসহ এলাকার প্রায় ১২ গ্রামের লোকজন সেতু দিয়ে যাতায়াত করেন। দুই শতাধিক মানুষের টানা ১৪/১৫ দিনের পরিশ্রমের ফলে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। নদীর মধ্যবর্তী জায়গা খুবই গভীর। দুটো বাঁশকে জোড়া দিয়ে নাট মেরে খুঁটি তৈরি করা হয়। এরপর নদীর গভীর জায়গায় দেয়া হয় লম্বা কয়েকটি খুঁটি। এভাবেই শত শত মানুষের প্রচেষ্টায় সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এতে প্রায় ১৫ দিন লেগে যায়। সেতুটি নির্মাণে প্রায় ৫ লাখ টাকার বাঁশ লাগে। কত কষ্ট হয় আমাদের। বর্ষায় খেয়া নৌকা আর শুকনো মৌসুমে বাঁশের সেতু আমাদের নিজেদের অর্থেই তৈরি হয়। একটি স্থায়ী সেতু হলে ১২টি গ্রামের লোকজন এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবেন।
আশারকান্দি ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফজলু মিয়া জানান, সেতু স্বচক্ষে না দেখলে অনুধাবন করা যাবে না কতটি বাঁশ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। এখানে সেতুর কতটুকু প্রয়োজন সেটি যে কেউ দেখেই বুঝতে পারবে। কিন্তু সেতু আর হয় না। অনেক দিন ধরে কেবল শুনেই আসছি এখানে সেতু হবে। কতবার মাপজোঁকও নিয়েছে। কিন্তু কোনো ফলাফল মিলেনি।’
জানা গেছে, সেতু দিয়ে অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত নির্বিঘ্নে লোকজন যাতায়াত করেন। কোনো কোনো সময় বিলম্বে বর্ষা এলে সেতু দিয়ে চলাচল অব্যাহত থাকে। কিন্তু নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথেই খেয়া নৌকার চলাচল শুরু হয়ে যায়। তখন সেতুটি ভেঙে বাঁশ নিয়ে যাওয়া হয়। হালোখাল নদীর উত্তর পাড়ের দাওরাই, মিলিক, কালাম্বরপুর, শুক্লাম্বরপুর, শুম্ভপুর, কালাঞ্জুরা, দিঘলবাক দক্ষিণ, কালনীরচর, বড়ফেচী, ঐয়ারকোণা, মিঠাভরাং, জয়দা গ্রাম এবং দক্ষিণ পাড়ের উত্তর দাওরাই, দারুল ইসলাম, মধুপুর, ছইদাবাদ, জামারপুর, রৌডর, রুপসপুর গ্রামের লোকজন সেতু দিয়ে যাতায়াত করেন। এই সেতু পার হয়েই স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বাজার, ইউনিয়ন অফিস, তহশিল (ভূমি) অফিসে যেতে হয়। এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও সরকারি দপ্তরে এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে দুর্ভোগ নিয়ে সাধারণ লোকজন ও শিক্ষার্থীদেরকে চলাচল করতে হচ্ছে।