‘শুকনা মৌসুমে চললেও বর্ষায় গাড়ি-ঘোড়া আয় না’
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মার্চ ২০২৩, ৬:৫০:০৮ অপরাহ্ন
২০ বছরেও উপজেলা সদরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি
কোম্পানীগঞ্জের ইছাকলস ইউনিয়নের ॥ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
‘শুকনার সময় মোটামুটি চলা যায়, বর্ষায় মানুষের খুব কষ্ট, গাড়ি-ঘোড়া আয় না। আনলেও ঠেক্কাইয়া-ঠুক্কাইয়া আনা লাগে। মানুষ জানর উপরে তুলিয়া আনে, খুব কষ্ট করিয়া। উপজেলা সদরের সাথেও সরাসরি যোগাযোগ নাই। কাঁচা রাস্তা। এক কথায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকায় আছি আমরা।’
হাওর ও জলাভূমিবেষ্টিত কোম্পানীগঞ্জের ইছাকলস ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন সেখানকার পুটামারা গ্রামের বাসিন্দা ও ঐতিহ্যবাহী সিলেট এম সি কলেজের ইংরেজি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুবেল আহমদ (২১)।
রুবেল নিজ গ্রাম থেকে গত সোমবার সকালে সিলেটে আসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এভাবে-‘সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠি। মেঘ দিছে-এ কারণে বাড়ি থেকে জুতা খুলে যাই। পুরো রাস্তায় পেক (কাঁদা) হয়ে গেছে। চলাচল করেনি কোন যান। পুটামারা থেকে বাগজুর পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা পাঁয়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। খুব খারাপ অবস্থা। অর্থাৎ, রাস্তা নিয়ে আমাদের দুর্দশার শেষ নেই।’
কেবল পুটামারাই নয়, এ ইউনিয়নের ১৯টি গ্রামের সাথে উপজেলা সদরের যোগাযোগ তো দূরের কথা, পুরোপুরি আন্ত:গ্রাম যোগাযোগও গড়ে উঠেনি। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, পুরো ইউনিয়নে মাত্র তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তা। আর কাঁচা রাস্তা ৪২ কিলোমিটার।
কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল ইউনিয়ন ভেঙ্গে ২০০৩ সালে গঠিত হয় ৪ নং ইছাকলস ইউনিয়ন। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ইউনিয়নটির জনসংখ্যা ৪৬ হাজার ৯৩৭ জন। ১৮.৫০ বর্গমাইলের ইউনিয়নটির স্বাক্ষরতার হার শতকরা ৪০ ভাগ, বলছে উইকিপিডিয়া।
ইউনিয়নের বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার ২০ বছরেও উন্নয়ন বঞ্চিত এ ইউনিয়ন। ইউনিয়নটির সাথে এখনো উপজেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সূচকে পিছিয়ে আছে এ ইউনিয়ন।
পুটামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পুটামারা গ্রামের বাসিন্দা তারা মিয়া জানান, ইছাকলস একটি অবহেলিত ও জনবিচ্ছিন্ন জনপদ। ইউনিয়নের ইছাকলস, ফুটকুরা টিলা ও টুকেরগাঁও-অনেকটা বিচ্ছিন্ন গ্রাম। এসব গ্রামের লোকজনের চলাচলেরও কোন রাস্তা নেই।
এ এলাকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি উল্লেখ করে এ শিক্ষক বলেন, এলাকার মানুষ নির্ভরশীল বোরো ফসলের ওপর। এলাকায় কিছু মৎস্যজীবী আছেন। বন্যায় হাওরের ফসলহানি হলে তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। কিছু মানুষ দিনমজুর। কিছু জমিতে আউশ-আমন চাষ হলেও আগাম বন্যায় অনেক সময় সে ফসলও তলিয়ে যায়। বর্ষার ৬ মাস মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা ছোট ছোট নৌকা। হাওরে বেড়িবাঁধের কারণে চলাচল করতে পারে না বড় নৌকাও।
তিনি বলেন, উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা পারকুল-যুগীরগাঁও-কলাপাড়া-বর্ণি রাস্তা। রাস্তাটি আধা-কাঁচা পাকা। রাস্তা নিয়ে স্থানীয় লোকজন ৬ মাস চলাচল করতে পারলেও বর্ষায় উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। রাস্তাটি উচু করা গেলে লোকজন বছরের পুরো সময় রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারতো। জেলা সদরের সাথেও যোগাযোগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা সমাজকর্মী মশরুর আহমদ জানান, রাস্তা-ঘাটের ক্ষেত্রে তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। বিশেষ করে বর্ষাকালে তাদের দুর্ভোগ অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ দুর্ভোগ লাঘবে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত বলে তার মন্তব্য।
ইছাকলস ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান সাজ্জাদুর রহমান সাজু জানান, কোম্পানীগঞ্জের সবচাইতে দুর্গম ইউনিয়ন হচ্ছে ইছাকলস। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। কোন প্রকল্প পাস হলে যাতায়াতের অভাবে ইঞ্জিনিয়ার-ঠিকাদার যেতে চায় না। ইউনিয়নটি সিলেট সদর উপজেলার সবচাইতে কাছাকাছি অবস্থানে। পাশাপাশি সুরমা নদী পাড়ি দিলেই ছাতক উপজেলা।
ইউনিয়নের বাসিন্দাদের ৬ মাস নৌকায় ৬ মাস সড়ক পথ দিয়ে চলাচল করতে হয়-জানিয়ে এ ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া বিকল্প নেই। ইউনিয়নের রাস্তা ওয়াটার লেভেল (পানির সমপরিমাণ) পর্যন্ত ভরাট করলে অন্তত মানুষের চলাচলের পথ সুগম হবে। পরবর্তীতে এসব রাস্তা পাকাকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা-ঘাটও এখনো মেরামত হয়নি বলে জানান এ ইউপি চেয়ারম্যান।
এলাকার মানুষ মূলত কৃষির ওপর নির্ভর উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষকদের অধিকাংশই বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। কিছু প্রবাসী থাকলেও তাদের বেশীরভাগই মধ্যপ্রাচ্যে। এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য শিবপুর-বিষ্ণুপুর, বাগজুর-পারকুল, শিবপুর-টুকেরবাজার-ইছাকলস রাস্তা নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করে ইউপি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ এ ইউনিয়নকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)-এর উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে বর্তমানে দুটি প্রকল্প চলমান আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এ দুটি প্রকল্প পর্যাপ্ত নয়।
ইউনিয়নের রাস্তা-ঘাট নিয়ে উদ্বিগ্ন এলাকার প্রবাসীরাও। মালয়েশিয়া প্রবাসী কমিউনিটি নেতা ও স্থানীয় পারকুল গ্রামের বাসিন্দা রাজু আহমেদ জানান, যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের ইউনিয়ন অনেকটাই অবহেলিত। লামা পারকুল, পুরান পারকুল, নতুন পারকুল ও যুগীরগাঁও বাগজুর গ্রামের রাস্তার সংযোগ গোয়াইনঘাটের সালুটিকরের সাথে স্থাপন করা গেলে এসব মানুষের নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিশ্চিত হবে।
সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ, একীভূত তেলিখাল ও ইছাকলস ইউনিয়নের ৫ বারের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ আব্দুল্লাহ (শায়েস্তা মিয়া) হাওর ও জলাভূমি বেষ্টিত এ ইউনিয়নের সামগ্রিক উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন। ৮৭ বছর বয়সী সাবেক এ জনপ্রতিনিধি ও সাবেক স্কুল শিক্ষক শায়েস্তা মিয়া বলেন, জীবদ্দশায় তিনি তার এলাকার উন্নয়ন দেখে যেতে চান। এজন্য তিনি বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন। তার প্রস্তাবিত প্রকল্প সমূহের মধ্যে রয়েছে-জালালাবাদ ইউনিয়নের কালীরগাঁও গ্রামের রাস্তা হতে পশ্চিম দিকে পুটামারা গ্রাম হয়ে বিষ্ণুপুর গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে বাগানসি হতে শিবপুর গ্রাম হয়ে টুকেরগাঁও খেয়াঘাট পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ, পুন:নির্মাণ ও পাকাকরণ, ছাতক উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগের জন্য পুটামারা নলডলিখালের ভাঙ্গায় ব্রিজ নির্মাণ, শিবপুর গ্রামের উত্তর বাগানসি খালের ভাঙ্গায় ব্রিজ নির্মাণ, শিবপুর গ্রামের পশ্চিম পুকরিয়া বিলের ভাঙ্গায় ব্রিজ নির্মাণ,পুটামারা হতে ইছাকলস ইউপি অফিস হয়ে পারকুল বাজার পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ পুন:নির্মাণ ও পাকাকরণ, মইয়াখালের ভাঙ্গায় ব্রিজ নির্মাণ, সাতকান্দার ভাঙ্গায় ব্রিজ নির্মাণ। তিনি বলেন, এরশাদ সরকারের আমলে নলডলি খালে ব্রিজ নির্মিত হলে বর্তমানে এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তার মতে, পুটামারা-কালিরগাঁও রাস্তা নির্মিত হলে মানুষের চলাচলের বিকল্প পথের সৃষ্টি হবে।
যোগাযোগ করা হলে এলজিইডি’র কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আসিফ খান জানান, ইছাকলস ইউনিয়নের জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে বিশেষ কোন বরাদ্দ দেয়া হয় না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) ও উপজেলা পরিষদের রাজস্ব থেকে মূলত ইউনিয়নভিত্তিক বরাদ্দ দেয়া হয়। এ প্রকৌশলী বলেন, উপজেলা সদরের সাথে এ ইউনিয়নের সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও লোকজন অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে উপজেলা সদরে আসতে পারেন। তিনি জানান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)-এর উদ্যোগে ইছাকলস ইউনিয়নের কলাপাড়া- যুগীরগাঁও এক কিলোমিটার রাস্তার কাজ চলমান আছে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৬১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। আর ইউনিয়নের বাগজুর ব্রীজ হতে শিবপুর পর্যন্ত ৯০০ মিটার রাস্তা আরসিসি ঢালাইয়ের জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে-এক কোটি ৭০ লাখ টাকা।
সেভ দ্যা হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, হাওর ভূ-তত্বের এক অনন্য সৃষ্টি। হাওরকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে এক ধরণের সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। হাওরের বাস্তুসংস্থান ও জীবনমান অক্ষুন্ন রেখে হাওর এলাকার উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান এ পরিবেশবাদী।